শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা
নাগরিক যন্ত্রণা (শেষ)

রাজউকের গভীর মনোযোগ শুধু বাণিজ্যের দিকেই

ভাঙা হচ্ছে না ঝুঁকিপূর্ণ ভবন

রাজউকের গভীর মনোযোগ শুধু বাণিজ্যের দিকেই

রাজউকের কিছু কর্মকর্তার গাফিলতি, বাড়িমালিকদের সঙ্গে অসৎ যোগসাজশ এবং আইন শাখার সময়োপযোগী পদক্ষেপের অভাবে ঢাকার বিপজ্জনক ভবনগুলো ভেঙে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ২০০ ভবন এলাকাবাসীর জন্য মরণফাঁদ হয়ে রয়েছে। এর মধ্যে ‘মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত বহুতল ভবন প্রায় সাড়ে তিন শ।
এসব ভবন যথাযথ নকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি নয়। এগুলোয় রাজউকের অনুমোদন নেই, মানসম্পন্ন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়নি। এসব ভবনে বাসিন্দাদের বিন্দুমাত্র নিরাপত্তারও ব্যবস্থা নেই। বিপজ্জনক এসব ভবন অবিলম্বে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে টিম হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের পর পর তিনটি বৈঠকেও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে নগরবাসীকে বিপদমুক্ত করার জন্য কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবু গেল নয় বছরে দায়িত্বশীল সংস্থার কর্মকর্তারা একটি ভবন ভেঙে ফেলারও উদাহরণ দেখাতে পারেননি। ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘর ভেঙে ফেলার ব্যাপারে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কড়া নির্দেশ এখনো ‘কাগুজে সিদ্ধান্ত’ হিসেবেই ফাইলবন্দী। অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সমন্বিত চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হয়নি এখনো, ভবন ভাঙার কাজও শুরু করা যায়নি। ২০০৪ সালের জুনে শাঁখারীবাজারে মর্মান্তিক ভবনধসের পরপরই আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়- দুই মাসের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলা হবে। এ সিদ্ধান্ত জরুরিভাবে বাস্তবায়নের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে শক্তিশালী টিমও গঠন করা হয়। কিন্তু শুরু থেকেই সমন্বয়হীনভাবে পরিচালিত টিমটি গত নয় বছরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে পারল না। ঢাকা জেলা প্রশাসনের হিসাবে ১ হাজার ২০০ ঘরবাড়িকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। অন্যদিকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের তালিকায় জরাজীর্ণ ভবনসংখ্যা দেখানো হয় ৫৬৭টি। কিন্তু রাজউকের পুরনো এক তালিকা অনুযায়ী রাজধানী এলাকায় দেড় হাজারেরও বেশি বাড়িকে জরাজীর্ণ ও বিপজ্জনক ভবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এসব বাড়ির মধ্যে ৯৫০টি ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ি ‘এ মুহূর্তেই ভাঙা প্রয়োজন’ বলেও রাজউক কর্মকর্তারা মনে করেন। এ মুহূর্তেই ভেঙে ফেলার জন্য আংশিক যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে এরও কোনো বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।
মামলা-রিট-নিষেধাজ্ঞা : অননুমোদিত ভবন-স্থাপনা ভাঙা ও অবৈধভাবে রাস্তা-মাঠ-জলাশয় দখল করে গড়ে তোলা বাড়িঘর উচ্ছেদে রাজউকের নেওয়া বেশির ভাগ সিদ্ধান্তই আইনি বেড়াজালে আটকে আছে। রাজউক সূত্র জানায়, বাড়িমালিকদের করা মামলা, উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল ও আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় চরম ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ভবনও ভেঙে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। অননুমোদিত ভবন ভাঙার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নেওয়ার পরও শুধু মামলার কারণেই তা বাস্তবায়নে মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। রাজউক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন জানান, পরিকল্পিত নগরায়ণের লক্ষ্যে অবৈধ ভবন ভেঙে নগরবাসীকে ঝুঁকিমুক্ত রাখা, বাড়িঘর অবৈধভাবে গড়ার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া, যত্রতত্র নিয়মবহির্ভূতভাবে বহুতল ইমারত নির্মাণ বন্ধে বাধ্য করার মতো জনস্বার্থমূলক অসংখ্য পদক্ষেপ নানা আইনি জটিলতায় ঝুলে পড়ে। ফলে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার জন্য রাজউকের নেওয়া জরুরি সিদ্ধান্তও বেশ কয়েক বছর ধরে আটকে আছে। এ ছাড়া নতুন ইমারত নির্মাণে বাধা দেওয়ার কাজেও রাজউক আর পেরে উঠছে না। এ ক্ষেত্রে রাজউকের আইন শাখার কর্মকর্তারা বলেছেন, মাত্র চারজন লোকবল নিয়ে প্রশাসনিক, আদালতের ও বিভাগীয় পর্যায়ের সাড়ে আট হাজার মামলা পরিচালনা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ওপর প্রতিদিনই নিত্যনতুন রিট পিটিশন ও নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনার বিপরীতে আইনি লড়াই চালানোটা আরও দুরূহ।
নিরুদ্দেশ আবাসিক চেহারা : ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরা মডেল টাউন পর্যন্ত এলাকার ‘আবাসিক চেহারা’ অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। সেখানে কোনটা আবাসিক আর কোনটা বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকা তা বুঝে ওঠা কঠিন। আবাসিক ভবনেরই নিচ তলায় কারখানা কিংবা ওয়ার্কশপ। দোতলা, তিন তলা ও চার তলাকে বানানো হয়েছে ব্যস্ততম মার্কেট। এরও ওপরের তলাগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে আবাসিক ফ্ল্যাট হিসেবে। একই স্থানে শিল্প-বাণিজ্য-আবাসিকের গলাগলি সহাবস্থান চলছে। সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জঞ্জালপূর্ণ পরিবেশ। বিভিন্ন সময়ে রাজউক থেকে আবাসিক ভবন নির্মাণের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরেই অ-আবাসিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করে আসছে। প্লট বরাদ্দের চুক্তিপত্র লঙ্ঘন করে সেসব আবাসিক প্লটে কেউ কেউ শিল্প কারখানা পর্যন্ত গড়ে তোলেন। এসব প্লট বরাদ্দের চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে রাজউক দফায় দফায় প্লটমালিকদের নোটিস দিয়েছে, বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলো অবিলম্বে ভেঙে ফেলার জন্য চরম পত্রও পাঠানো হয়েছে তিনবার। কিন্তু রাজউকের এসব হুমকি, নোটিস, ঘোষণাকে মোটেও পাত্তা দেননি প্লটমালিকরা। বরং বনানী ও বারিধারা থেকে উত্তরা পর্যন্ত আবাসিক ভবনগুলোর অবৈধ বাণিজ্যিক ব্যবহার কার্যক্রমের বিস্তার ঘটেছে। অবৈধভাবে আরও নতুন নতুন বহুতল বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠেছে।
তীব্র নকশাজট : রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) চলছে তীব্র নকশাজট। প্রায় পাঁচ হাজার নকশা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সময়মতো নকশা না পাওয়ায় বহু গ্রাহক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু কিছু কর্মকর্তাকে উপঢৌকন দিলে দ্রুত নকশা অনুমোদন হয়ে যায়। নয় তো বছরের পর বছর এ টেবিল থেকে ও টেবিল ঘুরতে হয়। জানা গেছে, গত সাড়ে চার বছরে প্রায় পাঁচ হাজার নকশা অনুমোদনের অপেক্ষায়। অথচ নকশা অনুমোদন কমিটির (বিসি কমিটি) বৈঠকও সময়মতো হচ্ছে না।
তবু কেন হুকুমদখল?: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নগরীর আবাসন সমস্যার সমাধানে উত্তরার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফেইজ, কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল, রূপগঞ্জের পূর্বাচল, নিকুঞ্জ-১, নিকুঞ্জ-২সহ অন্যান্য প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩০ হাজার একর জমি হুকুমদখল করে। সেসব জায়গা উন্নয়নের মাধ্যমে প্লট বানিয়ে হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু রাজউক এ পর্যন্ত উত্তরা মডেল টাউন ও নিকুঞ্জ ছাড়া অন্যান্য প্রকল্পের প্লট তৈরি ও হস্তান্তর করতে পারেনি। ওই প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ না করেই পুনরায় প্রকল্প সম্প্রসারণের নামে বড়কাউ-পাড়াবর্থার বনাঞ্চলসহ আবাসিক বাড়িঘর হুকুমদখলের পরিকল্পনা কেন- সে ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী।
বলা হচ্ছে, নিরাপদ নগর গড়ার দিকে নয়, রাজউকের গভীর মনোযোগ শুধু বাণিজ্যের দিকেই। হুকুমদখল প্রসঙ্গে রাজউক কর্মকর্তারা বলেছেন, পূর্বাচলের পর অত্যধিক চাহিদার কারণেই প্রকল্প সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যথারীতি প্রকল্প ব্যয় থেকে হুকুমদখলের খরচ হস্তান্তর করার পরই গাজীপুর জেলা প্রশাসন হুকুমদখল কার্যক্রম হাতে নেয়।

সর্বশেষ খবর