শিরোনাম
শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

অস্ত্র চোরাচালানে আওয়ামী লীগ বিএনপি নেতারা

২১টি সীমান্ত ও একটি উপকূলীয় জেলা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অবৈধ অস্ত্র

অস্ত্র চোরাচালানে আওয়ামী লীগ বিএনপি নেতারা

দেশের ২১টি সীমান্ত ও একটি উপকূলীয় জেলা দিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে অবৈধ অস্ত্র। আর এই অবৈধ অস্ত্র দিয়ে সংঘটন হচ্ছে খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর সব অপরাধ। এসব অপরাধের কারণে সামাজিক নিরাপত্তা যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে তেমনি স্বাভাবিক জনজীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমনি অবস্থায় সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা অবৈধ অস্ত্র চোরাকারবারি ও তাদের গডফাদারদের নামের তালিকা তৈরি করে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জমা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদন পুলিশের মহাপরিদর্শক ও বিজিবির মহাপরিচালককে দেওয়া হয়েছে। ‘ভারত হতে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি ও এর সাথে জড়িতদের নাম ঠিকানা প্রসঙ্গে বিশেষ প্রতিবেদন’ শীর্ষক ওই গোপন প্রতিবেদনের উদ্ধৃতাংশের আলোকে প্রদত্ত তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য র‌্যাবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৬ পাতার ওই গোপন প্রতিবেদনে সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোনা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এবং উপকূলীয় বরিশালের কারা কারা অস্ত্র চোরাকারবারি তাদের নাম ও ঠিকানা উল্লেখের পাশাপাশি অনেকের রাজনৈতিক পরিচয়ও তুলে ধরা হয়েছে। তালিকায় দেখা যায়, অস্ত্র চোরাকারবারিরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কাছে যেমন আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছেন তেমনি কোনো কোনো অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের আশীর্বাদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ কারবার চালিয়ে আসছেন। অনেক সময় গডফাদারদের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও পারেন না। বেশ কয়েকটি এলাকায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিুপদের সদস্যরাও চোরাকারবারিদের সহায়তা দিয়ে আসছেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। 

সীমান্ত জেলায় অবৈধ অস্ত্র চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িতদের নামের তালিকায় দেখা যায়- নেত্রকোনায় তাজুল, মজিম, আবদুর রশিদ, বিল্লাল হোসেন, মতিউর রহমান, মোবারক হোসেন ও আবদুল হক মিয়া। কুমিল্লায় ঠোঁট কাটা নাসির, অশোককুমার, শাহজাদা, রাকিব, আলমগীর, আমিনুল ইসলাম একরাম, রানা, গ্রিন ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট ও ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ডের পরিচালক আসাদুজ্জামান ভুট্ট, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর একরামুল হক বাবু ওরফে ককটেল বাবু, সাইফুল ও কিবরিয়া। ওই এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের গডফাদার হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্র সংসদের সাবেক এক নেতা, কুমিল্লা জেলা ছাত্রদলের এক নেতা, জেলা যুবদলের এক নেতা। এ ছাড়া কনকাপৈত ইউনিয়ন পরিষদের একজন সাবেক চেয়ারম্যানের নাম রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রয়েছে জুম্মন, জুয়েল, কালনের নাম। ফেনীতে অস্ত্র চোরাকারবারি রয়েছেন নয়জন। তারা হলেন জিয়াউদ্দিন ডালিম, সুমন ওরফে কুল সুমন, আনোয়ারুল হোসেন পাটোয়ারী, ফেনী পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ হিল মাহমুদ শিবলু, খোরশেদ আলম, মনোয়ার হোসেন দুলাল, খোরশেদুল আলম বাচ্চু, গাজী হাবিবুল্লাহ বাহার মানিক ও যুবলীগ কর্মী ইউসুফ শাহীন। তাদের গডফাদার হচ্ছেন যুবলীগ কর্মী জিয়াউল আলম মিস্টার, ফজলুর রহমান বকুল ও মঙ্গলকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দাউদুল ইসলাম মিনার। রাজশাহীতে যারা অবৈধ অস্ত্রের বেচাকেনা করেন তারা হলেন হায়দার আলী, মাসুম, কালু মিয়া, নাছির উদ্দিন বাবু, আসলাম মেম্বার, বাবু ডাকাত, আবদুল মোমিন, বাচ্চু মিয়া, নাসির উদ্দিন, রেজাউল হক রেজা, হ্যাপী, রফিকুল ইসলাম, মাসুদ রানা, নওশাদ আলী জামাতী, জাহাঙ্গীর আলম, মনিরুল ইসলাম, খায়রুল ইসলাম, কাশেম আলী, মজিবর রহমান বিশু, আলমগীর ওরফে আলো, সুইট, রুহুল আমীন, মাজহারুল ইসলাম ও মানিক ওরফে কুংফু মানিক। নওগাঁয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের গডফাদার হলেন সোলায়মান আলী, শরিফুল ইসলাম, আয়নাল ও নাজমুল। চাঁপাইনবাবগঞ্জে অস্ত্র চোরাকারবারিদের ১৫ জন গডফাদারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মেরাজ, আওয়ামী লীগ সমর্থক ও শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য সেনাউল, একই ইউনিয়নের যুবলীগ সভাপতি আখেরুল ও দুর্লভপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য বিএনপি সমর্থক মোশাররফ হোসেন। জয়পুরহাটে অস্ত্র চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ১৩ জন। তাদের মধ্যে সুলতান, আবদুল মালেক ওরফে ফাটা বাবু, হুমায়ুন কবীর, রুহুল আমিন, সাখাওয়াত হোসেন কুতুব, কবির হোসেন মজনু মেম্বার ও অমল চন্দ্র বর্মণ উল্লেখযোগ্য। তাদের গডফাদার পাঁচবিবি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবু সাইদ আল মাহমুদ চন্দন, পাঁচবিবি পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব, জয়পুরহাট পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ, জয়পুরহাট জেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন হিমু, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহফুজ চৌধুরী, জয়পুরহাট শহর বিএনপির সাবেক সভাপতি ফয়সাল আলীম, গোলজার হোসেন, জাকারিয়া হোসেন কমল, ফড়িং, শঙ্কর, আবদুল মালেক ওরফে ফাটাবাবুসহ বেশ কয়েকজন। যশোরে অস্ত্র চোরাকারবারি আছেন ২২ জন। তাদের মধ্যে মিয়ারাজ আলী, আয়ুব হোসেন ওরফে কালা আয়ুব, কামাল হোসেন, শাহাবুদ্দিন, জসিম উদ্দিন, রিংকু, তোফাজ্জল ও সাদ্দাম হোসেন উল্লেখযোগ্য। তাদের প্রশ্রয়দাতারা হলেন ফকির আহমেদ, বাদশা, অশোক, আইজুল ও আওয়ামী লীগ সমর্থক আলিমুর উল্লেখযোগ্য। ঝিনাইদহ জেলায় অস্ত্র চোরাকারবারিদের গডফাদার হিসেবে কাজ করছেন গণমুক্তিফৌজের নেতা আনোয়ার হোসেন দেবু, গান্না ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল ওহাব ও মতিয়ার রহমান। কুষ্টিয়ায় অস্ত্র চোরাকারবারি রয়েছেন ২৫ জন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জাহাঙ্গীর কবির লিপটন, কাজল মজুমদার, টাইগার আলমের ভাই শাহান, হ্যাবল ও আওয়ামী লীগ সমর্থক রাশেদুজ্জামান ছন্দ। ওই এলাকায় গডফাদারের তালিকায় আছেন মিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন, মিরপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক, কুষ্টিয়া-১ আসনের এমপি রেজাউল হক চৌধুরীর ছোট ভাই টোকেন চৌধুরী ও নিষিদ্ধ চরমপন্থি সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর বর্তমান কর্ণধার আলী রেজা। চুয়াডাঙ্গায় অবৈধ এই ব্যবসায়ীদের গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন দর্শনা পৌর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাহারুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ সমর্থক আবদুল আজিজ, মশিউর রহমান, দর্শনা পৌরসভার সাবেক কমিশনার নফর আলী, মো. এলপি, স্থানীয় বিএনপির অহিদুল গ্রুপের নেতা ইরন, মোজাম্মেল গ্রুপের নেতা খোকন, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির মুকুল গ্রুপের প্রধান মুকুল, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সোহাগ গ্রুপের সদস্য আক্তারুজ্জামান সোহাগ ও হাবিবুর রহমান ওল্টু। মেহেরপুরে অস্ত্র চোরাকারবারির তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন লিটন, মনিরুল, মজনু, হালিম, মুকুল মিলিটারি, লিটন মিলিটারি, আমিরুল, হাসান মেকার উল্লেখযোগ্য।
ওই এলাকার গডফাদার হলেন গাংনী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলীম উদ্দিন, গাংনী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য করিফুল ইসলাম ওরফে ন্যাড়া। অস্ত্র চোরাকারবারিরা ভারতের কার কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেন তাদেরও নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে ওই গোপও প্রতিবেদনে। সাতক্ষীরার অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে ছামছুজ্জামান, মিলন মেম্বার, হাসান, সেলিমসহ ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হযেছে। ওই এলাকায় গডফাদারের তালিকায় যারা রয়েছেন তারা হলেন আলীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রউফ ও কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশাদুল। বরিশালে ৩১ জন অস্ত্র চোরাকারবারির মধ্যে শহিদুল ইসলাম, রাজা কসাই, কামরুল হাসান রতন, সাগর উদ্দিন মন্টি, মনির মোল্লা, মাসুম ব্যাপারি, রিপন ওরফে বোমা রিপন, মির্জা আবুয়াল হোসেন অরুণ, সিদ্দিক গাজী, খায়রুল উল্লেখযোগ্য। দিনাজপুরে রয়েছেন ২০ জন অস্ত্র চোরাকারবারি। তাদের গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে পাঁচজনকে। এ ছাড়া সিলেটে ১৬, সুনামগঞ্জে ১০, হবিগঞ্জে ৫, রাঙামাটিতে ১২, খাগড়াছড়িতে ৮, বান্দরবানে ২৬ জন অস্ত্র চোরাকারবারি ও গডফাদার রয়েছেন। 

প্রতিবেদনের মন্তব্য কলামে উল্লেখ করা হয়েছে- সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র মজুদ রয়েছে। এসব অস্ত্র প্রতিবেশী ভারত থেকে আসছে। দুই দেশের কিছু অসাধু ব্যক্তির যোগসাজশে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র চোরাচালান হয়; যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। অস্ত্র চোরাকারবারিদের এহেন দৌরাত্ম্যে চলতে থাকলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা ক্রমেই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে ধারণা করা হয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রদত্ত তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এসব অবৈধ অস্ত্র সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডেও ব্যবহৃত হতে পারে। স্থানীয় কিছু রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি এবং সীমান্ত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় সীমান্ত পথে অবৈধ অস্ত্র আসছে। 

গোপন প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে- অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ বন্ধের লক্ষ্যে সীমান্তে স্থাপিত বর্তমান বিওপি বা চেকপোস্টসহ যেসব স্থানে নতুন বিওপি কিংবা চেকপোস্ট স্থাপন প্রয়োজন যেসব স্থান চিহ্নিত করে সব বিওপি ও চেকপোস্টে বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়নপূর্বক টহল জোরদার করা আবশ্যক। যেসব অস্ত্র চোরাকারবারির বিরুদ্ধে থানায় অস্ত্র মামলা রয়েছে ওই মামলাসহ থানায় অন্যান্য অস্ত্র মামলাও (যদি থাকে) দ্রুত নিষ্পত্তি করা জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে যেসব জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অস্ত্র চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিসহ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার রোধে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনার সুপারিশ করা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর