শিরোনাম
শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

পাহাড়ের কোলে কষ্টের পড়ালেখা

খাড়াই পাহাড়ে চার মাইল চড়াই শেষে ঢাল বেয়ে নিচে নামতে হয় আরও তিন মাইল। এই চড়াই-উৎরাই মিলে সাত মাইল হাঁটা পথ চলে স্কুলে যায় নেপালি ছেলেমেয়েরা। নিত্যদিনের এই কষ্টসাধ্য পথ চলা নেপালের শিক্ষার্থীদের কাছে একেবারেই তুচ্ছ বিষয়। এ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনাই নেই। নগরকোট এলাকার শ্রী মহাকালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির বর্ষা সাহা বলেন, ‘কষ্ট কীসের? কুয়াশা ঠেলে দলবেঁধে হেঁটে স্কুলে যাতায়াতে মজা লাগে। বাড়ি থেকে দুই ঘণ্টা আগে বেরোই, যেন ক্লাস মিস না হয়।’
বাসে চড়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে ২৮ নভেম্বর শুক্রবার দুপুরে কাঠমান্ডু থেকে শত কিলোমিটার দূরে নগরকোট পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাই। ওই দিন স্কুল হাফবেলা। তাই ছুটি শেষে ইউনিফর্ম পরা ছোটছোট শিশু বইভর্তি ব্যাগ পিঠে বেঁধে হাতে হাত ধরে বাড়ি ফিরছে। তাদের মধ্যে বাড়ি ফেরার তাড়াটাও চোখে পড়ার মতো। পথ আটকে জিজ্ঞেস করতেই সানজু তামাং নামের নবম শ্রেণির এক ছাত্রী বললেন, ‘চলতে চলতে দেড় ঘণ্টিকে বাদ বাড়ি ফেরেঙ্গে। কাহাছে সময় চলযায়া নেহি মালুম।’ সানজু পরিবার নিয়ে বাস করে নগরকোট পাহাড় চূড়া থেকে ৯ মাইল ঢালের নানদুম গ্রামে। সেখান থেকে প্রতিদিন ২৫ জন শিশু নগরকোট মহাকালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তে আসে নিয়মিত। এই বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রমিলা খড়কা থাপা বলেন, বিদ্যালয়ের চার শতাধিক শিক্ষার্থীর অধিকাংশই দূরের গ্রাম থেকে চড়াই-উৎরাই পাহাড়ি পথ হেঁটেই যাতায়াত করে। এর বিকল্প কোনো যানবাহন নেই। অভিভাবক ঝুনু শ্রেষ্ঠা বলেন, ছয় মাইল হেঁটে পাঁচ বছরের ছেলে রাজীব শ্রেষ্ঠাকে স্কুলে দিতে হয়। আবার নিয়ে যেতে হয়। ওর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে এটুকু কষ্ট তো সইতেই হবে।
নগরকোট পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত সানরাইজ স্কুলটি পরিচালনা করেন স্থানীয় শিক্ষানুরাগী রবি সুয়াল। তার স্কুলে দুই শতাধিক শিশু শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। বোর্ডিংয়েরও ব্যবস্থা আছে। সেখানে থাকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের ১০ জন শিক্ষার্থী। রবি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গোটা নগরকোটে তিন লাখ মানুষের বসবাস। সরকারি ও বেসরকারি মিলে ৯টি বিদ্যালয় এখানে। তবে কোনো কলেজ নেই। এখানকার শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষিত। তারা ইংরেজি ও হিন্দিতে পারদর্শী। কৃষি ও পর্যটনকেন্দ্রিক তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য। তিনি জানান, নগরকোট থেকে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী এখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছে। কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ছে ২০ জনের বেশি শিক্ষার্থী।
নগরকোট পাহাড় উচ্চতায় প্রায় ৮ হাজার ফুট। চূড়ায় শহর। এই পাহাড়কে ঘিরে বেড়ে ওঠা ছোট ছোট অসংখ্য পাহাড়ের ঢালেও মানুষের বসবাস। চারদিকে সবুজের সমারোহ। সকালে ও বিকালে এই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। এই দৃশ্য দেখতেই প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ পর্যটক আসেন নগরকোটে। সূর্য পশ্চিমের পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়েছে। কুয়াশার চাদরে ঢেকে ফেলছে গোটা পাহাড়। তার ভেতর দিয়ে বাসে চড়ে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে কাঠমান্ডু ফেরা। তখনো কানে বাজছে স্কুলশিক্ষক জয়ন্দ্র বৈদ্যের উক্তি ‘পাহাড়ের এই চড়াই-উৎরাই বেয়েই এখানকার নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে উঠছে নীরবে-নিভৃতে।’

সর্বশেষ খবর