মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

সংকটে রাজশাহীর রেশম

সংকটে রাজশাহীর রেশম

স্থানীয়ভাবে সিল্ক সুতার উৎপাদন হ্রাস এবং এর আমদানি নির্ভরতার কারণে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে রাজশাহীর রেশম শিল্প। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশি সুতার উৎপাদন কমেছে। পেশা বদলেছেন শিল্পীরা। ফলে রেশম তার অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। তবে যারা এখনো টিকে আছেন, তারা রেশমের প্রতি ভালোবাসার কারণেই রয়েছেন।
সংকট সম্পর্কে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতির (নাসিব) রাজশাহী জেলা সভাপতি লিয়াকত আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় ৭৭টি কারখানার মধ্যে এখন চালু আছে মাত্র ১০টি। এর মধ্যে পাওয়ার লুম চালু রেখেছে চারটি কারখানা। বাকিরা প্রিন্টিংয়ের কাজ করে কোনো রকমে টিকে আছেন। চালু কারখানার মধ্যে সপুরা সিল্ক, আধুনিক সিল্ক, আমেনা সিল্ক, ঊষা সিল্ক, সিল্ক ফ্যাশন অন্যতম।
রাজশাহীর রেশম শিল্পের সংকট সম্পর্কে এক অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, এক সময় রাজশাহীতে ব্যবসায়ীরা সিল্ক সুতা উৎপাদন করতেন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সুতার পাশাপাশি চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়াসহ বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও সুতা আমদানি করা হতো। তবে প্রসিদ্ধ রাজশাহী সিল্ক মূলত তৈরি হতো স্থানীয় সিল্ক সুতা থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে রাজশাহী সিল্কের গ্রহণযোগ্যতার মূল কারণ ছিল স্থানীয় ওই সুতা। স্থানীয় এই সিল্ক সুতার বড় সরবরাহ আসত প্রতিবেশী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট থেকে। রাজশাহীর বাঘা ও চারঘাটেও উৎপাদিত হতো সুতা। সেই সময় তৈরি সিল্ক কাপড়ের ৮০ শতাংশেই ব্যবহৃত হতো স্থানীয় সুতা। তখন যে রেশম কারখানাগুলো সুতা উৎপাদন করত, কেবল তারাই দেশের বাইরে থেকে সিল্ক সুতা আমদানির লাইসেন্স পেত। ওই সময় আমদানিকৃত সুতার ওপর সরকারি ট্যাক্স ছিল ৩০ শতাংশ। কিন্তু এই চিত্র পাল্টে যায় ১৯৯১ সালের পর থেকে। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে সরকার সিল্ক সুতা আমদানির লাইসেন্সের ক্ষেত্রে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্থানীয় পর্যায়ে সিল্ক সুতা উৎপাদন না করলেও যে কেউ তা আমদানি করতে পারবে। ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে ট্যাক্স তুলে নেওয়া হয় আমদানিকারকদের ওপর থেকে। ফলে অতি উৎসাহী ব্যবসায়ীদের কারণে বাজার সয়লাব হতে শুরু করে চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম আর উজবেকিস্তান থেকে আমদানি করা সিল্ক সুতায়। সরকারি সিদ্ধান্তের সুযোগে এসব সুতার আমদানি যতো বাড়তে থাকে, স্থানীয় সিল্ক সুতার উৎপাদনও ততো হোঁচট খেতে থাকে। সিল্ক সুতার অবাধ আমদানির সুযোগে স্থানীয় সুতার উৎপাদন একেবারেই শূন্যের কোটায় পৌঁছে যায়। একপর্যায়ে সরকার আবারও নেয় নতুন সিদ্ধান্ত। এবারের সিদ্ধান্তে আমদানিকৃত সুতার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারিত হয়। পরে সেই ভ্যাট বাড়িয়ে ২২ শতাংশ করলেও এতে স্থানীয় পর্যায়ে সিল্ক সুতা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোনো লাভ হয়নি। উল্টো বিদেশি সুতা আসা কমে যাওয়ায় এখন সুতার দামই বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, এখন যেসব সুতায় রাজশাহীর রেশম কাপড় তৈরি হয়, সেগুলো আসলে চীন থেকে আমদানি করা সুতোয় তৈরি। অন্য দেশগুলো সুতা রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় এখন ভরসা চীন। এই দেশটিও সুতা আমদানি বন্ধ করে দিলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী জানান, রেশম এক ধরনের কৃষিকাজ। অথচ কোনো প্রকার কৃষি ঋণ চাষিরা পায় না। এবারের বাজেটেও বিদেশি সিল্ক ফেব্রিক্সের ওপর শুল্ক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। এভাবে অথর্ব করে ফেলা হচ্ছে রেশম উন্নয়ন বোর্ডকে। তিনি বলেন, রাজশাহীতে ৭৭টি রেশম কারখানা থাকলেও রেশম উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদে কোনো রেশম ব্যবসায়ীকে রাখা হয়নি। যা রেশমের উন্নয়নে একটি প্রধান প্রতিবন্ধক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৃহত্তর রাজশাহীতে স্থানীয়ভাবে সুতা তৈরি হয় ৩৫ থেকে ৪০ টন। কিন্তু বর্তমানে শুধু রাজশাহীতেই রেশম কারখানাগুলোতে সুতার চাহিদা ২৫০ টনেরও বেশি। ফলে চাহিদা মেটাতে ২০০ টনেরও বেশি সুতা প্রতি বছর চীন থেকে আমদানি করতে হয়। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ছাতারি, চকছাতারি, পাকুরিয়া, কালিগ্রাম, মনিগ্রাম, মীরগঞ্জ, বলরামপুর, আলাইপুর, মোহদিপুর, হরিরামপুর, বাউসাসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় রেশম চাষ হতো। এখন আর তা নেই।  রেশম চাষিরা পেশাও ছেড়েছেন। এখন কেবল মোহদিপুর, হরিরামপুরসহ কয়েকটি এলাকায় রেশম চাষ হয়। ১৯৬০ সালে রেশমের রমরমা চাষের সময় গঠিত হয় মীরগঞ্জ রেশম গুটি উন্নয়ন সমবায় সমিতি। সেই সময় থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মীরগঞ্জের ভানুকর গ্রামের আবদুর রহমান সরকার। তিনি জানান, ওই সমিতির সদস্য সংখ্যা ছিল ১৪১ জন। কিন্তু দিনে দিনে এ সংখ্যা কমতে কমতে এখন তলানিতে। রেশম বোর্ডের উপ-প্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবু তাহের জানান, বর্তমানে বোর্ডের নিজস্ব মালিকানাধীন ১ হাজার ১৭০ বিঘা জমিতে ৪ লাখ তুঁতগাছ আছে। বাকি ১০ হাজার আছে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে। এক সময় তারা পরিত্যক্ত জমিতে তুঁতগাছ রোপণে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু এতে দেখা যায়, জমি পরিত্যক্ত রেখে তাতে তুঁতচাষে আগ্রহ কম থাকে। সে কারণে এখন তারা নতুন করে ফসলি জমিতেও তুঁতগাছ চাষে উদ্বুব্ধ করছেন। তারপরেও তুঁতচাষ বাড়েনি।

সর্বশেষ খবর