সোমবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভোগান্তির শহর ঢাকার দুই সিটি

কর্মকর্তা দালাল-নির্ভর উত্তর-দক্ষিণ, সমস্যার পাহাড়, সমাধান নেই

ভোগান্তির শহর ঢাকার দুই সিটি

অন্তহীন দুর্ভোগ আর ভোগান্তিতে রাজধানীর বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। সমস্যার পাহাড় কিন্তু সমাধান নেই। বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তার অস্তিত্ব হারিয়ে রীতিমতো স্রোতবাহী খালে পরিণত হচ্ছে। এখানে-সেখানে পড়ে থাকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, চার পাশে দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। সামান্যতম নাগরিক সেবাও মিলছে না। জন্মনিবন্ধন থেকে মৃত্যুসনদ- সব ক্ষেত্রেই দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি আর ভোগান্তি। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে বিভক্ত করে নাগরিক সুবিধা বিস্তারের ঘোষণা থাকলেও এর কোনো নমুনা দেখতে পাচ্ছেন না নাগরিকরা। বরং নাগরিক জীবনযাত্রার ন্যূনতম সুবিধাও দিন দিন হাতছাড়া হচ্ছে। মশক নিধন, রাস্তাঘাট সংস্কার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কোনো কাজেই গতি নেই। এর ওপর বছরজুড়ে চলছে রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। ঘন ঘন লোডশেডিং, বিদ্যুৎহীন অন্ধকার অলিগলি, গ্যাস স্বল্পতায় টিমটিম করে জ্বলে চুলা, পানির জন্য চলছে হাহাকার। ঘর থেকে বের হলেই আরও শতেক জঞ্জাল-যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয়। দুঃসহ যানজটে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকাই থাকে অবরুদ্ধ। রাস্তাঘাট-অলিগলি পচাগলা দুর্গন্ধময় পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। জলাবদ্ধতা বহু মহল্লার স্থায়ী দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা, উৎকট দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। রাজধানীর জীবনযাত্রায় ‘বিশেষ মান’ নিশ্চিত করা দূরের কথা, ঢাকায় বেঁচে থাকাটাই এখন রোজকার লড়াই।
প্রধান প্রধান রাস্তার ওপরে যেন সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে রীতিমতো ময়লা-আবর্জনার হাটবাজার বসানো হয়েছে। একেকটি স্থানে ৭-৮টি করে কন্টেইনার টার্মিনাল বসিয়ে অলিগলি, বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা তুলে এনে সেসব কন্টেইনার ডাস্টবিনে রাখা হচ্ছে। ব্যাপারটি অনেকটা ঘরের ময়লা রাস্তায় প্রদর্শনের মতো। কুড়িল-মালিবাগের প্রগতি সরণির বারিধারা ও মধ্যবাড্ডা এলাকায় এ ধরনের দুটি ময়লার বাজার আছে ঠিক রাস্তার মধ্যখানেই।
কর্মকর্তা আর দালাল নির্ভর ডিসিসি : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় কর্মকর্তা নির্ভর হয়ে পড়েছে ওয়ার্ড অফিসগুলো। আর এসব কর্মকর্তার অবহেলার কারণে ন্যূনতম সেবা পেতেও চরম ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী। সেবাপ্রার্থীরা সেবা নিতে গিয়ে কর্মকর্তার পরিবর্তে তাদের নিযুক্ত দালালদের খপ্পরে পড়ে নানারকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আবার অনেকে জাল সনদ বিক্রির বাণিজ্যও শুরু করছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই কিছু না কিছু সেবা পেতে ওয়ার্ড অফিসগুলোতে ভিড় করেন নাগরিকরা। এরমধ্যে নাগরিক সনদপত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ, ওয়ারিশের সনদ, মৃত্যু সনদ, ছবি সত্যায়নের কাজেই বেশি আসেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ৯২টি ওয়ার্ডেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তথা কাউন্সিলর না থাকায় এখন এসব কাজের জন্য ভরসা করতে হয় ওয়ার্ডের কর্মকর্তার ওপর। আর এই কর্মকর্তাকেও খুঁজে পাওয়া যায় না।
ময়লা-আবর্জনায় বেহাল : ডিসিসি নির্মিত প্রায় ৭০টি পাবলিক টয়লেটের সবগুলোই ব্যবহারের অনুপযোগী। পথ-চলতি মানুষ বিপজ্জনক এ টয়লেট ব্যবহারের পরিবর্তে অবিবেচকের মতো ফুটপাতকেই টয়লেট বানিয়ে ফেলেছে। ফলে মলমূত্রের কারণে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলাই এখন দুরূহ। রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো একেকটি যেন ময়লা-আবর্জনার আধার হয়ে উঠেছে। কাপ্তানবাজারের নোংরা ময়লা অব্যবস্থাপনা গুলিস্তান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। পুরো রাস্তাজুড়েই ফেলে রাখা হয়েছে জবাই করা মুরগির নাড়িভুঁড়ি, পালক, গরু-ছাগলের মলমূত্র। সেখানকার বেশিরভাগ ব্যবসা কেন্দ্রে শত শত মুরগি জবাই করে নাড়িভুঁড়িসহ সব ময়লা-উচ্ছিষ্ট সরাসরি রাস্তায় নিক্ষেপ করা হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজার মাছের আড়তের আশপাশ দিয়ে দ্রুত গতির গাড়িতে চলাচলেরও জো নেই। দুর্গন্ধের ঝাপটায় এক মুহূর্তেই অসুস্থ বানিয়ে দেয়। ভোরের ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকার পরিবেশ খুবই নাজুক। অনেকেই অভিযোগ করেছেন- ‘রাজধানীর আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু আছে বলে মনে হয় না। ঘুপচি মহল্লাতেও এত বড় বড় যে এপার্টমেন্ট নির্মিত হয়েছে- অথচ কোনোটির সঙ্গেই ডাস্টবিন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি।’ সিটি করপোরেশনের উত্তর ও দক্ষিণের দফতর সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার হাজার টন ময়লা-আবর্জনা জমে ওঠে। এরমধ্যে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগ সর্বোচ্চ তিন হাজার টন ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করতে পারে। অবশিষ্ট ময়লা-আবর্জনা রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, ড্রেন-নর্দমায় আটকে থাকে-উড়াউড়ি করে বাতাসে। চলছে জাল সনদের ব্যাণিজ্য : দুই ডিসিসি কার্যালয়গুলো ঘুরে কোনোটিতেই সাবেক কাউন্সিলরের খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অসাধু ব্যক্তিরা স্বাক্ষর জাল করে আগের তারিখে সনদ দিয়ে দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো কার্যালয়ের স্টাফরা ‘নগর ভবন’ থেকে সনদ স্বাক্ষর করিয়ে এনে দিচ্ছেন। এর বিনিময়ে তারা নিচ্ছেন বড় অঙ্কের টাকা। বাধ্য হয়েই তাদের টাকা দিতে হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, নাগরিকত্বের সনদের জন্য লোকজন ওয়ার্ড অফিসগুলোতে ভিড় করবে, এটাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষরা বলেন, একটি সনদের জন্য সেই উত্তর বা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অফিসে যেতে হচ্ছে। এর জন্য সময় যেমন যাচ্ছে, তেমনি অর্থের অপচয়ও করতে হচ্ছে। তাও একদিনে গেলে কাজ হচ্ছে না।
বেহাল যাতায়াত : প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলির রাস্তাঘাট পর্যন্ত বেহাল। ভাঙাচোরা, খানাখন্দে পূর্ণ রাস্তাঘাট এখন রাজধানীর অন্যতম সমস্যা। বাড্ডা-ভাটারা এলাকার অনেক রাস্তা দিনের পর দিন একহাঁটু নোংরা পানিতে নিমজ্জিত থাকায় কোনটা রাস্তা আর কোনটা ড্রেন-নর্দমা তা মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। সরেজমিন রাজধানীর সবুজবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান-বনানী, তেজগাঁও এলাকা ঘুরে অধিকাংশ ওয়ার্ডে রাস্তাঘাটের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি দেখা গেছে। জনচলাচলের প্রতিটি রাস্তা ভেঙেচুরে একাকার, দু-চার ফুট অন্তর ছোট বড় খানাখন্দক-বিপজ্জনক গর্ত। বেশিরভাগ এলাকায় গত ১০ বছরে রাস্তার সংস্কার না হওয়ায় পিচঢালাই উঠে চষা জমির আকৃতি ধারণ করেছে। রাস্তার স্থানে স্থানে ম্যানহোলের ঢাকনাগুলো ফাঁকা রয়েছে। ভাঙা রাস্তা, ময়লার স্তূপ, জলাবদ্ধতা, মশার উৎপাতসহ নানা সমস্যার বিষয়ে নগরবাসী অভিযোগ করলেও কোনো ফল মিলছে না। রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকাতেও রাস্তাঘাটের বিপন্নদশা চোখে না দেখলে বুঝার উপায় নেই। রোজকার লড়াই দেখা যায় অফিসগামী যাত্রীদের দিকে নজর দিলেই। রাজধানীর প্রতিটি পয়েন্টে শত শত নারী-পুরুষ কর্মস্থলে যাওয়া বা ফেরার সময় দীর্ঘক্ষণ গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকা এবং কোনো বাস-মিনিবাস পেলেই তাতে ওঠার প্রতিযোগিতায় যে কেউই অসহায়, অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মশার সঙ্গে বসবাস : মশার উপদ্রব নগর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মশার উপদ্রব বাড়লেও মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। মশা দমন, মশক প্রজননস্থল-যেমন ডোবা, নালা, বিল, ঝিল, নর্দমা ইত্যাদিতে নিয়মিত কীটনাশক ছিটানোর কথা থাকলেও সেসব বিষয় সিটি করপোরেশন শুধু বক্তৃতা, সেমিনার, লিফলেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। মাঠপর্যায়ে গত ৭-৮ মাসেও অনেক এলাকার মানুষ মশক নিধনের কোনো কার্যক্রম দেখতে পাননি। উত্তরা আজমপুরের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এই এলাকায় মশা এত বেশি যে মশার কয়েলেও কোনো কাজে আসে না। তা ছাড়া মশার কয়েলও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নকল। মশা তাড়াতে জ্বালানো কয়েলের ওপরই মশাগুলোকে বসে থাকতে দেখা যায়।’
ওভারপাস-আন্ডারপাসে যন্ত্রণা : রাজধানীর বেশিরভাগ ওভারব্রিজ দীর্ঘদিন ধরে বেদখল। ভিক্ষুক, পটেকমার, হকার ও বখাটেদের দখল কায়েম থাকায় পথচারীরা সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এসব ভোগান্তির পাশাপাশি নতুন মাত্রা সংযোজন হয়েছে উলঙ্গ পাগলদের উৎপাত। অধিকাংশ ওভারব্রিজে দৃশ্যত সিটি করপোরেশনের আদৌ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তৎপরতা নেই পুলিশেরও। চলাচলের ক্ষেত্রে পথচারীরা ওভারব্রিজ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকাটাই নিরাপদ মনে করেন। অন্যদিকে আন্ডারপাসগুলো এখন শতেক জঞ্জালে ঠাসা। রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে পথচারীরা পোহাচ্ছেন সীমাহীন ভোগান্তি। বজায় থাকছে না নিরাপত্তা। বিদ্যুৎ চলে যেতেই কারওয়ান বাজারের আন্ডারপাস পরিণত হয় অন্ধকার গুহায়। সেখানে মহিলারা শিকার হচ্ছেন নানা লাঞ্ছনার। গাবতলীর আন্ডারপাস থাকে পকেটমারদের দখলে। চলে দুর্বৃত্তদের আনাগোনা। রাজধানীর ব্যস্ততম আজিমপুর-মিরপুর ঘুরে দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের অর্ধেক সড়কবাতি জ্বলে না। আজিমপুর থেকে মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত সড়কপথে সিটি করপোরেশনের ৩৫১টি লাইট পোস্টের দুই পাশে মোট ৭০২টি সোডিয়াম বাতি। এরমধ্যে ৩৪৮টিই জ্বলছে না। সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মিরপুর রোড ধরে ১০ নম্বর গোল চত্বর পর্যন্ত সড়কে যে অর্ধেক বাতি জ্বলছে, এর এক-তৃতীয়াংশ অনেকটা না জ্বলার মতোই মিটমিট করছে।

সর্বশেষ খবর