শনিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

দেশ রক্ষার চ্যালেঞ্জে নারী সৈনিক

দেশ রক্ষার চ্যালেঞ্জে নারী সৈনিক

ওদের চোখে-মুখে তারুণ্যের উজ্জ্বল দীপ্তি। দূর থেকে ছোট করে ছাঁটা চুল দেখে মায়াবী একদল কিশোর বলে ভুল হতে পারে। ভারী অস্ত্র কাঁধেও সুশৃঙ্খল তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ। টানা এক বছরের কঠিন প্রশিক্ষণ শেষে ২৯ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে অবস্থিত শহীদ সালাউদ্দিন সেনানিবাসের শহীদ বীরউত্তম প্যারেড গ্রাউন্ডে সমাপনী কুচকাওয়াজে দেশের প্রথম নারী সৈনিক হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেছেন তারা। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন সাধারণ জীবনের ইতি টেনে দেশ রক্ষার প্রয়োজনে যে কোনো বিপদে কাজ করার শপথ নিয়েছেন ৮৭৯ জন নারী। আলাপ হলে সাদামাটা পরিবার থেকে উঠে আসা এক-একজন নারীর ইস্পাত কঠিন মনোভাবে এটি স্পষ্ট হয় যে, দেশের যে কোনো সংকটে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতেও তারা প্রস্তুত। ঘাটাইল সেনানিবাসে কুচকাওয়াজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে নারী সৈনিকরা জানান, সব জেনেই তারা কঠিন কিন্তু গৌরবজনক এ পেশা বেছে নিয়েছেন। এজন্য যদি জীবন দিতে হয় তাও পিছপা হবেন না। এভাবেই গত বৃহস্পতিবার নিজেদের তুলে ধরেন দেশের প্রথম নারী সৈনিক ব্যাচের সদস্যরা। কুচকাওয়াজ শেষে প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশের মাঠে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করতে দেখা যায় সৈনিকদের। এদেরই একজন রাজশাহীর মেয়ে হ্যাপী খাতুন। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, সৈনিক হিসেবে শপথ নিতে পেরে খুব ভালো লাগছে। আমাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। আরও দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে আমরা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসের সামরিক হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের সহযোগী হিসেবে কাজ করব। এজন্য শারীরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এখন বিভিন্ন মৌলিক বিষয়েও শিক্ষা নিচ্ছি।
কথা হলে সৈনিকরা জানান, প্রশিক্ষণের সময় তাদের প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে পিটি করে নাশতা শেষে দুপুর পর্যন্ত ক্লাস করতে হয়। এরপর খাওয়া ও বিশ্রাম বিকালে খেলাধুলা শেষে সন্ধ্যায় পড়ালেখা করতে হয়। জানা যায়, শারীরিক প্রশিক্ষণের মধ্যে তাদের ১৫ বার পুশ-আপ, তিন কি.মি.পর্যন্ত দৌড়ানোসহ বিভিন্ন ব্যায়ামের কৌশল অভ্যাস করতে হয়। এছাড়া বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা। কয়েকজন বলেন, প্রথম প্রথম ২-৩টা পুশ-আপ করতেই হাঁপিয়ে উঠতেন। কিন্তু এখন একবারেই ১৫টি পুশ-আপ করতে আর সমস্যা হয় না। অন্যদিকে শুরুতে ফায়ারিংয়ের প্রশিক্ষণে ভয় পেলেও এখন সে ভয়ও কেটে গেছে। কয়েকজন সৈনিক জানান, তাদের প্রশিক্ষণের শুরুতে যেদিন নিজেদের লম্বা চুল ছেঁটে ছেলেদের মতো করে কাটা হয় সেদিন অনেকেই কান্নাকাটি করেছিলেন। কিন্তু এখন আর কারও নতুন ধরনের এ কাটে অস্বস্তি নেই। তারা এর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন।
কথা হলে সৈনিক ফারহানা বলেন, আগে আমার এলাকার বখাটেদের কারণে পথ চলতে সমস্যা হতো। কিন্তু এখন ভয় ও জড়তা কেটে গেছে। কেউ এখন আমার সঙ্গে কিংবা অন্য নারীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে আসলে প্রতিবাদ জানাব। প্যারেড গ্রাউন্ডে সন্তানদের কুচকাওয়াজ দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাদের পরিবারকে। গত বৃহস্পতিবার মনোমুগ্ধকর সে প্রদর্শনী দেখে করতালি দিয়ে বারবার নিজেদের সে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন সৈনিকদের অভিভাবকরা। কুচকাওয়াজ শেষে সন্তানদের সঙ্গে আলাপ করতে আসা এক সৈনিকের গৌরবান্বিত মা সৌমিত্রা রানী মণ্ডল বলেন, আমার স্বামীর ইচ্ছা ছিল মেয়ে চিকিৎসক হবে কিন্তু মেয়ে তার ইচ্ছাই পূরণ করেছে। সৈনিক হয়েছে। আমরা তার এ সাফল্যে বেশ আনন্দিত ও গর্বিত।  জান্নাতুন নামের আরেক সৈনিক বলেন, শৈশব থেকেই সেনাবাহিনীতে কাজ করার স্বপ্ন দেখতাম। আমি মনে করি এ পেশার মাধ্যমে মানুষের সেবা করা সম্ভব। এছাড়া দেশসেবার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের দোয়াও পাওয়া যায়। কথা হলে সাহিদা নামের অপর এক সৈনিক জানান, ছদ্মবেশ নিয়ে, অন্য রূপ ধারণ করে শত্রুদের ঘায়েল করার যে চ্যালেঞ্জ এ পেশায় আছে তা বলে বোঝানোর নয়। ফাঁদ পেতে শত্রুকে আক্রমণ করার যে কৌশল সৈনিকদের রপ্ত করানো হয় তা অসাধারণ। আজ পবিত্র কোরআন শরিফ শপথ করে আমি দেশ রক্ষার প্রতিজ্ঞা করেছি। আর এ প্রতিজ্ঞা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চাই। সৈনিকরা আরও জানান, ভবিষ্যতে নারী হিসেবে তাদের ঘর-সংসার সামলানোর পাশাপাশি এ মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু পেশার খাতিরে দায়িত্ব পালনে তারা কোনো ছাড় দিতে নারাজ। এজন্য কোনো প্রতিবন্ধকতাকেই তারা গুরুত্ব দিতে চান না। খাওয়ার পর্ব শেষে তখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। এবার অভিভাবকদের ফিরে যাওয়ার পালা। নারী সৈনিকদেরও নষ্ট করার মতো সময় কই! আবারও প্রশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে সৈনিকরা অস্ত্র কাঁধে পিটি শুরু করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। চোখে-মুখে তাদের দৃঢ় প্রত্যয়। একজন নারীকে মা হিসেবে কখনো না কখনো দায়িত্ব নিতে হয়। আর মায়ের কাঁধে যখন দেশ রক্ষার মহান দায়িত্ব দেওয়া। তিনি তখন সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেন এমনটাই সবার বিশ্বাস।

সর্বশেষ খবর