বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
আগুন ঝরা মার্চ

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নগ্নরূপ দেখেছি

জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.)

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নগ্নরূপ দেখেছি

এখন মার্চ মাস। ইংরেজি ২০১৫ সাল। মার্চ আমাকে ভীষণ অস্থির করে তোলে। আমার হৃদয়ের প্রশান্তি কেড়ে নেয়। আমার স্বস্তি বিঘ্নিত করে। না চাইতেও স্মৃতির গভীরে চাপা-দেওয়া ঘটনাগুলো জোর করে জানালা খুলে বেরিয়ে আসে। ১৯৭১-এর মার্চ মাস ও তার ঘটনাপ্রবাহ বাঙালি ভুলবে কেমন করে! আজ ১৯৭১-কে চার দশকেরও বেশি সময় পিছনে ফেলে এসেছি আমরা। জীবন ইতিমধ্যে লম্বা ছায়া ফেলেছে। ছায়া দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে। তখন আমি যৌবনদীপ্ত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একজন তরুণ অফিসার। আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছি। আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বৈষম্যের নগ্নরূপ দেখেছি। এক বর্ণবাদী রূপ। তুমি বাঙালি তুমি ছোট আমি পাঞ্জাবি আমি বড়। একই সেনাবাহিনীতে, একই ছাউনিতে এমনকি একই পল্টনে পাশাপাশি থেকেও মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধান বিশাল। একটা অবহেলা, অবজ্ঞা, আর চাপা ঘৃণা আমরা বাঙালি অফিসাররা অহরহ অনুভব করেছি। বাঙালি হওয়া যেন এক বিরাট অপরাধ। তুমলোক বাঙালি হো। কুছ কামকা নাহি হো। ছোটা ছোটা আদমি হো। ছেরেফ মাছলি খাতে হো। গোটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা তখন অত্যন্ত নগণ্য। অফিসার পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকজন। অপমান আর অবজ্ঞার শিকার হতে বাঙালিরাও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত বোধ করত। বাংলায় কথা বলা যেত না। উর্দু বলতে হতো। উর্দু পরীক্ষায় পাস না থাকলে কমিশন নিশ্চিতকরণ (confirmation) হতো না। মেজর গনি ও কর্নেল ওসমানীর অক্লান্ত চেষ্টায় প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে এই রেজিমেন্ট ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। লাহোরের নিকটবর্তী খেমকারান সেক্টরে এ রেজিমেন্ট অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভারতের আগ্রাসন ঠেকিয়ে দিয়ে গোটা সেনাবাহিনীকে তাক লাগিয়ে দেয়। প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এককভাবে গোটা যুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য সবচেয়ে বেশি সামরিক পুরস্কারে (gallantry award) ভূষিত হয়ে এক কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান এই রেজিমেন্টের তখন একজন তরুণ অফিসার, একজন কোম্পানি অধিনায়ক। বেঙ্গল রেজিমেন্টের এ সম্মান, খ্যাতি, গৌরব ও স্বীকৃতি সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভীষণভাবে ঈশ্বান্বিত করে তোলে। তারা আরও মরিয়া হয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু বাঙালিরাও তখন আত্মউপলব্ধিতে জাগ্রত। তারা হীনম্মন্যতা ত্যাগ করে মাথা তুলে দাঁড়ায়। তাদের উৎকৃষ্টতা জাহির করার লক্ষ্যে মেধা ও দক্ষতাকে শাণিত করে, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়, সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে সংগ্রাম করে চলে। প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা ও স্পোর্টসে, বিভিন্ন যুদ্ধের মহড়ায়, কোর্স ক্যাডার, শৃঙ্খলায় ও সামরিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ও প্রতিযোগিতায় বাঙালি ইউনিটগুলো ও অন্যান্য ইউনিটের বাঙালি অফিসার ও সৈনিকেরা শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয়। ১৯৭১ মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে সবচেয়ে কঠিন সময় যারা পার করেছে, চরম মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ে ভুগেছে, মানসিক যন্ত্রণায় কাতর থেকেছে তারা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে অবস্থিত বাঙালি ইউনিটগুলোর  বাঙালি সেনা সদস্য, সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকরা। এ এক দুঃসহ সময়, এক অগ্নি পরীক্ষা। তারা প্রত্যক্ষ করছে স্বাধীনতার চেতনায় উত্তাল গোটা দেশ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে সব মানুষ। টানটান উত্তেজনা। চরম পরিস্থিতি। শুধু মিছিল আর মিছিল চর্তুদিকে। সরকারের হুকুম কেউ মানছে না। কারফিউ ব্রেক হচ্ছে যত্রতত্র অহরহ। সেনা ছাউনির পাঞ্জাবি ইউনিটগুলো ইতোমধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপরে। গুলি চালিয়ে হত্যা করছে। কঠিন শক্ত হাতে পূর্ব পাকিস্তান শাসন করতে, অবাধ্য বাঙালিদের উচিত শিক্ষা দিতে পাকিস্তান সামরিক সরকার অবলম্বন করেছে পোড়ামাটির (scorch earth) নীতি burn all, loot all, kill all, জ্বালাও, পোড়াও হত্যা কর। বাঙালি সেনা অফিসাররা, আন্ডার কমান্ড বাঙালি সৈনিকেরা কী করবে? কী করবে পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের অসীম সাহসিকতার খ্যাতিসমৃদ্ধ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি ইউনিটগুলো যারা বেশ কয়েকটা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করেছিল। তারা কি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে তাদের ভাইয়ের মৃত্যু, মায়ের অপমান, বোনের নির্র্যাতন। তারা কি শুধু নিশ্চুপ হয়ে হাত-পা গুটিয়ে থাকবে, নীরব দর্শক হয়ে যখন রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে তাদের প্রিয় মাতৃভূমির রাজপথ আর প্রান্তর? অত্যন্ত কড়া নজরদারি তাদের ওপরে। ভীষণ ঝুঁকিতে তাদের সবার জীবন। তাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া আঁচ করে তাদের নিরস্ত্র করার জন্য ছাউনির পাঞ্জাবি ইউনিটগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা এক্ষুণি এই মুহূর্তে। কঠিন সিদ্ধান্ত, জীবন-মরণের সিদ্ধান্ত। to be or not to be. হয় বীরের মতো বিদ্রোহ আর প্রতিরোধ যুদ্ধ না হয় কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ।
চট্টগ্রাম সেনাছাউনির অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াসহ অন্যান্য সেনাছাউনির বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঢাকার নিকটবর্তী জয়দেবপুরে অবস্থান উপ-অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ঝাঁপিয়ে পড়ল কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানরত উপ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। তেমনি যশোর সেনানিবাসের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট।
এর পরের ইতিহাস রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের কঠিন ইতিহাস। শত সহস্র গেরিলা অভিযান, রেইড, এ্যামবুশ, শত্রুঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ, সম্মুখযুদ্ধ, অ্যাটাক, কাউন্টার অ্যাটাক, ইস্পাতকঠিন মনোবল আর মৃত্যুপণ লড়াইয়ের ইতিহাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্তের আখরে লেখা এক অনবদ্য গৌরবগাথা, এক বীর জাতির মহিমামণ্ডিত বীরত্ব কাহিনী, জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জনের এক অমর আখ্যান। এ মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশকে ব্র্যাকেটবন্দী করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে, ব্র্যাকেটবন্দী করেছে মাওসেতুংয়ের নেতৃত্বে গণচীনের এবং হোচিমিন পরিচালিত ভিয়েতনামের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। আমাদের গর্ব আমাদের জাতীয় সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগৃহে, এর উত্থান এর বিকাশ মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে। এ সেনাবাহিনীই গোটা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, ফোর্স সংগঠিত করেছে, অস্ত্র সংগ্রহ করেছে, রসদ সম্ভার জুগিয়েছে, অভিযান পরিচালনা করেছে, শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। দেশকে স্বাধীন করেছে।
আজ বাংলাদেশ এক স্বাধীন, সার্বভৌম গর্বিত দেশ। আজ চির উন্নত নজরুলের বাংলাদেশের শির। হিমালয়ের উচ্চতায় বিশ্ব সভায় সে দৃশ্যমান। আজ বিশ্বজুড়ে গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত, অশান্ত রাষ্ট্রগুলোয় শান্তির দূত হয়ে সে বিশ্বশান্তি রক্ষায় অবদান রেখে চলেছে। সে নোবেল জয় করেছে। বিশ্ব ক্রিকেটাঙ্গন দৃপ্ত পদে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ২০০ বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলে দিয়ে অতীতের উপনিবেশ প্রভু ব্রিটিশকে হারিয়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে। জয় বাংলাদেশের। জয় স্বাধীনতার। অগ্নিঝরা মার্চের আজকের এই দিনগুলোতে আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বীর সেনানীদের কথা, তাদের বীরত্বগাথা। স্মরণ করছি বীর সমরনায়ক, সমর অধিনায়কদের। স্মরণ করছি সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আর অর্পণ করছি আমার চৌকসতম চৌকস স্যালুট।

সর্বশেষ খবর