বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিলীনের পথে চট্টগ্রামের ১৭ খাল

বিলীনের পথে চট্টগ্রামের ১৭ খাল

মির্জা খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) একটি চারতলা ভবন। বহদ্দারহাট সংলগ্ন কালারপোল এলাকাজুড়ে খালটি সরু হয়ে এখন প্রায় পুরোটাই বেদখলে। খালটির মির্জাপুল অংশে ৩০ ফুটের মধ্যে বর্তমান দৃশ্যমান আছে মাত্র পাঁচ ফুট। তাও আবার ময়লা আবর্জনার স্তূপে পানির স্রোত নেই বললেই চলে।

শুধু মির্জা খালই নয়, চট্টগ্রাম নগরীতে ঐতিহ্যবাহী ১৭টি খালেরই আজ একই দশা। দখল-দূষণে সব খালই এখন মৃতপ্রায়। অস্তিত্ব হারানোর পথে এক সময়ের নৌকা চলাচলের খরস্রোতা এ খালগুলো। ভরাট, দখল-বেদখল, দূষণ, আবর্জনা, অবাধে পাহাড় কাটা ও পাইলিংয়ের মাটির কবলে পড়েছে চট্টগ্রামের সৌন্দর্যবর্ধিত এসব খাল। রক্ষক হয়ে সিটি করপোরেশন নিজেই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীও দখল-বেদখলে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। গতকাল সরেজমিনে বেশ কয়েকটি খাল ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, নগরীতে ১৪৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বড় খাল আছে ১৭টি। এসব খালের শাখা-প্রশাখা আছে আরও অন্তত ১৭টি। খালগুলোর মধ্যে আছে- চাক্তাই খাল, মির্জা খাল, রাজা খাল, চশমা খাল, নাছির খাল, বির্জা খাল, খন্দকিয়া খাল, খাজির খাল, গয়না ছড়া খাল, বামনশাহী খাল, কাট্টলি খাল, ত্রিপুরা খাল, ডোম খাল, শীতল ঝর্ণা খাল, হিজরা খাল, মহেশখাল ও ডাইভারশন খাল। জানা যায়, চাক্তাই খালের গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৮৮ সালে পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৫ কোটি ১১ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যয়ে খালটি খনন করা হয়। ১৯৯২-৯৩ অর্থ বছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দ্বিতীয় দফায় ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে ভূমি অধিগ্রহণ কাজে এবং ৩ কোটি ৭৫ লাখ ৯০ হাজার টাকায় খালের পাড়ে দেয়াল নির্মাণ ও খনন কাজে ব্যয় হয়। পরে ২০০৩ সালে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে তৃতীয় দফায় খালের তলা ও পাশ পাকাকরণের কাজ করা হয়। তারপরও 'চট্টগ্রামের দুঃখ' চাক্তাই খালের অবস্থা তথৈবচ। এ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনের সচিব আবদুর রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে দাবি করেন, 'খালগুলো থেকে মাটি অপসারণ, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান-জরিমানা, আবর্জনা পরিষ্কার, স্থানীয় জনসাধারণকে খাল পরিষ্কারে সচেতনতা-এসব কাজ চসিকের রুটিন ওয়ার্ক। প্রতিনিয়ত এসব কাজ চলে আসছে। তবে খালগুলো দিয়ে যাতে দ্রুতগতিতে পানি নিষ্কাষণ হয় সেজন্য নিয়মিত খাল খনন ও পরিষ্কার করা হয়। এ ব্যাপারে আমরা সব সময় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছি।' গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চাক্তাই খালের বহদ্দারহাট মোড়ের প্রাইমারি স্কুলের পাশের অংশে একটি ড্রেজার। খালের পাড়ে আছে মাটির স্তূপ। এসব মাটি আবার দখল করেছে খালের প্রায় ১০ ফুট অংশ। এই খালেই আছে আবর্জনা স্তূপ। এই কালভার্টের পশ্চিম অংশ অধিকাংশই ভরাট হয়ে আছে পার্শ্ববর্তী আবাসন প্রকল্পের পাইলিংয়ের মাটিতে। বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার, কালারপুল ও খতিবের হাট হয়ে যাওয়া মির্জা খালটির চানমিয়া রোড অংশে প্রায় পুরো ভাগ দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে স্বয়ং সিটি করপোরেশন। এখানে স্থাপন করা হয় চসিকের রাজস্ব সার্কেল-২। ভবনের উত্তর পাশ্বর্ের অধিকাংশ খালই বেদখল। সামান্য অংশ আবর্জনা ভেদ করে দেখা গেলেও এ অংশের প্রস্থ মাত্র সর্বোচ্চ পাঁচ ফুট। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীলদের প্রশ্ন করা হলে ভয়ে কেউ এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি। বদরখাল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খালের ওপর সিটি করপোরেশন একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে রেখেছে। আরেকটি অবৈধ দখলদার দ্বিতল মার্কেট নির্মাণ করে রেখেছে। একপাশে খালের রেলিং, আরেকপাশে এসব দালান। স্বাধীনতার আগে এই খালের ওপর দিয়ে নৌকা চলাচল করলেও এখন পানি নিষ্কাশনও দুরূহ ব্যাপার।

চট্টগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাল হলো চাক্তাই খাল। বহদ্দার হতে খালটি উৎপত্তি হয়ে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ৫ কিলোমিটার খালটি এখন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে সিটি করপোরেশন যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে খালের তলা পাকাকরণের মতো একটি আত্দঘাতী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম নগরবাসী মূলত জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে। এ কারণে খালের পূর্বের অবস্থায় না গিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় তলা পাকাকরণের কাজ সম্পন্ন করা হয়। এতে খালের প্রকৃত নাব্যতা হারায়। চাক্তাই খালের পার্শ্ববর্তী রাজার খালের কর্ণফুলীর মুখ অংশেও চলছে দখলের প্রতিযোগিতা। মির্জা খালের মুরাদপুরের দক্ষিণে মির্জা পুলের পূর্বে ৪০-৫০ ফুটের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ভরাট, দখলদারদের লোভাতুর দৃষ্টি পড়েছে ওই খালটিতে। চাক্তাই খালের চকবাজার কাঁচাবাজার অংশ আবর্জনায় ভরাট। পানি চলাচল হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। চাক্তাই খালের ডিসি রোড, দেওয়ান বাজার অংশের অবস্থাও বেহাল। কর্ণফুলী নদী সংলগ্ন বিবি মরিয়ম খালটি এখন প্রায় বিলীন। নতুন নির্মিত ব্রিজের দক্ষিণে দখল করে হয়েছে বহুতল ভবন। ভরাট হওয়া খালে দখলদাররা স্থাপন করেছে টয়লেট। কর্ণফুলী থেকে পাথরঘাটা পর্যন্ত অংশের খালটিকে দেখতে মনে হবে একটি জঙ্গল। এ খাল দিয়ে এতটুকু পানিও চলাচল করে না। আগ্রাবাদ এলাকার নাসির খাল দখলে নিয়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ বসতি। আগ্রাবাদ সরকারি কমার্স কলেজ হোস্টেলের পেছন দিয়ে যাওয়া খাল দখল করে গড়ে উঠেছে নানা বসতি। এ খালের অধিকাংশ অংশই অবৈধদের দখলে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির নেটওয়ার্ক সদস্য অ্যাডভোকেট মোস্তফা মোহাম্মদ এমরান বলেন, খাল দখল, ভরাট ও যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলানোর জন্য অনেকাংশে দায়ী সিটি করপোরেশন। অনেকেই নকশাবহির্ভূতভাবে খালের ওপর বসতবাড়ি বা স্থাপনা নির্মাণ করছে। এর সঙ্গে জড়িত সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাছাড়া সিটি করপোরেশন মাঝে মধ্যে খাল খনন ও সংস্কার কাজ চালালেও পরবর্তীতে তা খোঁজখবর রাখে না। সাধারণ নাগরিকরাও অসচেতনভাবে খালে ময়লা-আবর্জনা, অপচনীয় পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল ফেলছে। এ ব্যাপারে নাগরিকদেরও দায় দায়িত্ব রয়েছে।

সিটি করপোরেশনের উপসহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সুদীপ বসাক বলেন, একটি খালের যে অংশে মাটি অপসারণ করা হয় বৃষ্টি হলেই আবারও সেখানে মাটি ভরাট হয়ে যায়। তাছাড়া প্রতিটি খালের পাড়ে পাড়ে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। এসব ভবনের পাইলিংয়ের মাটি কোথায় যায় তা নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না। কারণ অধিকাংশ খালই ভরাট হয়েছে পাইলিংয়ের মাটিতে। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, মাটি উত্তোলন হলে তা যায় কোথায়। অথচ ইতিমধ্যে নুর নগর হাউজিং, আরেফিন নগর ও হালিশহরে অপসারিত মাটির স্তূপ রয়েছে। এখানে রীতিমতো একটি করে বড় আবাসিক এলাকা করা যাবে।

 

সর্বশেষ খবর