মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা
কাঠমান্ডুতে কিশোরী ফুটবলারদের শ্বাসরুদ্ধকর একদিন

চোখে ভাসছিল প্রিয় মুখগুলো

চোখে ভাসছিল প্রিয় মুখগুলো

কয়েক ঘণ্টা পরই এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গার্লস চ্যাম্পিয়নশিপের আঞ্চলিক ফাইনাল। প্রতিপক্ষ নেপাল। কাঠমান্ডুর অদূরে টিম হোটেলে বসে ম্যাচের ছক আঁকছেন কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। মেয়েদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার তরিকা। এমন সময় হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায় প্রজেক্টরের রশ্মি বিকিরণ। ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ে ছেদ পড়ে। কী হলো? ছোটনের প্রশ্ন তরঙ্গায়িত হওয়ার আগেই দুলে উঠে জমিন। সঙ্গে হোটেলের সুদৃঢ় স্তম্ভগুলোও। দুলতে থাকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশছোঁয়া বিল্ডিংগুলো। তুলোর মতো উড়তে থাকে ওসব বিল্ডিং থেকে ছিটকে পড়া নানান আসবাবপত্র। মেয়েরা বলে উঠে, স্যার আমরা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভব করছি। দ্রুত হোটেল ছেড়ে পাশের ঝুম ক্ষেতে আশ্রয় নেয় ফুটবলার ও ম্যানেজমেন্টসহ ২৩ জনের দলটা। শনিবারের সকাল তখন ১১টা পেরিয়ে গেছে। এরপরই শুরু হয় জীবনের এক ভয়ঙ্করতম অধ্যায়। গতকাল মুঠোফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে নেপালের শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তগুলোর বর্ণনা দিচ্ছিলেন কোচ ছোটন, দলের তারকা ফুটবলার মৌসুমী ও স্বপ্না। হঠাৎ করেই পৃথিবীটা দুলে উঠল। সাজানো স্বপ্নগুলো কেমন ফিকে হয়ে যেতে লাগল। মনের কোণে ভেসে উঠল প্রিয়জনদের মুখ। আর কি দেখতে পাব তাদের! ফাইনাল, ফুটবল, দল ওই শব্দগুলো তখন বহুদূরে চলে গেছে। মুছে গেছে ভূত-ভবিষ্যতের সব ছবি। অনূর্ধ্ব-১৪ দলের সহঅধিনায়ক মৌসুমী বলছিলেন, ‘বাবা, মা আর ভাই-বোনদের ছবিগুলো বারবার ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। মনে হচ্ছিল, আবার তাদের দেখতে পাব তো!’ বেঁচে দেশে ফিরতে পারবেন বলেই ভাবতে পারছিলেন না মৌসুমী। অনেক মেয়েই কাঁদছিল। কোচ ছোটনের কাছে বারবার অনুরোধ জানাচ্ছিল, স্যার আমাদেরকে বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে চলুন। ছোট মেয়েদের দিকে তাকিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছিলেন কোচ। তিনিই বা কি করবেন! তিনিও রক্ত-মাংসের এক মানুষ। তার চোখও ঝাপসা হয়ে উঠে। তার চোখেও ভেসে উঠে প্রিয়জনদের মুখ। স্বপ্না যখন আকুল কণ্ঠে বলে উঠল, স্যার আমি বাবা-মায়ের কাছে যাব। ছোট্ট মেয়েটার আবদার শুনে ছোটনের চোখ ভিজে উঠেছিল। ‘প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম আমরা। অমন ভয়, এখনো মনে হলে শিউরে উঠি। সারা রাত আমরা ঘুমাতে পারিনি। ইরান এবং অন্যান্য দলের মেয়েরা হোটেলের বাইরে বিছানা করে ঘুমিয়েছে। আমরা ঘুমাতে পারিনি।’ বলছিলেন মৌসুমী। কোচ ছোটন বললেন, ‘মেয়েরা এতটাই ভয় পেয়েছিল তাদেরকে শত অনুরোধ করেও হোটেল রুমে ফেরত পাঠাতে পারিনি। আমরা পুরো দল বাইরেই কাটিয়েছি।’ কাঠমান্ডু থেকে বাসে এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত টিম হোটেলেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে ভূমিকম্পে। ফাটল ধরে এখানে সেখানে। আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নের সমাধি রচিত হয়েছে। গতকালই বাবা-মায়ের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে গেছে ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েরা। দুটো টেকটোনিকস প্লেটের উপর নেপালের অবস্থান। টেকটোনিকস প্লেটের সামান্য সংঘর্ষেও দুলে উঠে ভূপৃষ্ঠ। শনিবার এমনই এক সংঘর্ষে নেপালে শুরু হয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞ। পুলিশের ভাষ্যমতে, গতকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে তিন হাজার!
পুরো নেপালই যেনো এখন মৃত্যুপুরী। ওই মৃত্যুপুরীতেই ছিল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ দলের সদস্যরা। অভিভাবক, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনসহ পুরো দেশই তাদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় ছিল। অবশেষে বাংলাদেশের বিশেষ বিমানে করে নিরাপদে দেশে ফিরে দলটা। তারা নিরাপদে দেশে ফিরে আসায় কোচ আর ফুটবলাররাই কেবল নন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে পুরো দেশ।

সর্বশেষ খবর