মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা
গণপরিবহনে নৈরাজ্য (৫)

সিটিং গেটলকের নামে মাঝপথের যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে

সিটিং গেটলকের নামে মাঝপথের যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে

নগর পরিবহনে সিটিং, ডাইরেক্ট, গেটলকের নামে নজিরবিহীন নৈরাজ্য চলছে। মোটরযান আইন, সরকার নির্ধারিত ভাড়া সবকিছু উপেক্ষা করে যথেচ্ছ হয়রানিতে লিপ্ত পরিবহন মালিক শ্রমিকরা। ফলে যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে মালিকদের নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়া। সেটাও কিলোমিটার হিসাবে নয়, পরিবহন কোম্পানির নিজেদের ইচ্ছা মতো চাপিয়ে দেওয়া। অল্প দূরত্বের যাত্রীকে গুনতে হচ্ছে পুরো পথের ভাড়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অল্প দূরত্বের যাত্রীদের বাসেও তোলা হচ্ছে না। বিশেষ করে সিটি সড়কের মধ্যবর্তী এলাকার যাত্রীদের ভোগান্তিকে সঙ্গী করে নিজেদের গন্তব্যে যাতায়াত করতে হয়। রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে মতিঝিলে অফিস করেন বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে অফিসে যেতে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। সকালে মিরপুর-পল্লবী থেকে যেসব বাস ছেড়ে আসে সেগুলোর প্রায় সবই ‘সিটিং’, ‘গেটলক’ হিসেবে দরজা বন্ধ করে মাঝপথের হাজার হাজার যাত্রীর সামনে দিয়ে গন্তব্যের দিকে চলে যায়। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। তালতলা, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়ার যাত্রীরা এ সময় বাসে উঠতে পারেন না। এ জন্য তাদের সকাল ৯টায় অফিস ধরতে ৭টার আগেই রাস্তায় নামতে হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকালে অফিস যাত্রার সময়ে বাসে ওঠা এক কঠিন যুদ্ধের মতো।
ভাড়া ডাইরেক্ট, সার্ভিস লোকাল : রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসগুলোর মালিক সমিতি সিটিং, ডাইরেক্ট, লোকাল সিটিং, গেটলক ইত্যাদি বাহারি নামে যাত্রী পীড়নের সব আয়োজন দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে। অনেক বাসে একটাই ভাড়া, যাত্রী যেখানেই নামুক না কেন। ভাড়া ডাইরেক্ট হলেও যাত্রী কম পেলে তারা যে কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকাল বাসের মতোই যাত্রী তুলতে দ্বিধা করে না। মিরপুর থেকে মতিঝিল, গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী বাসগুলো মধ্যবর্তী দূরত্ব হিসেবে ফার্মগেট পর্যন্ত ১২ টাকা ভাড়া রাখে। মতিঝিল-গুলিস্তান পর্যন্ত ২৪ টাকা। মাঝখানে তাদের কোনো স্টপেজ থাকার কথা নয়। কিন্তু দুপুরে যাত্রী কম থাকলে তারা মাঝপথে বাস থামিয়ে যাত্রী নেয়। কিন্তু তাদের ভাড়া গুনতে হয় পুরো পথের। এমনকি শেওড়াপাড়া থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সিটিং সার্ভিসের নামে ১২ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এমনকি আগারগাঁও থেকে উঠে ফার্মগেট নামলেও ১২ টাকাই দিতে হয়। অথচ বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, শেওড়াপাড়া থেকে ফার্মগেটের দূরত্ব ৪.৬ কিলোমিটার। মিনিবাসে ভাড়া হওয়ার কথা ৬.৬৭ টাকা। অথচ দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে।
লোকাল বাসের খোঁজ নেই : নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে বর্তমানে মিরপুর-মতিঝিল বা মিরপুর-গুলিস্তান রোডে কোনো লোকাল বাস নেই। সব সার্ভিসই ডাইরেক্ট, সিটিং। কিন্তু অফ পিকআওয়ারে এসব বাস চলে লোকালের মতো, ভাড়া দিতে হয় ডাইরেক্ট বাসের। একই অবস্থা মিরপুর থেকে নগরীর অন্য রুটগুলোতে চলাচলকারী বাস সার্ভিসের ক্ষেত্রেও। মিরপুর থেকে চলাচলকারী চয়েজ, সিল্কসিটি, বিকল্প, বিহঙ্গ, শিখর, ইটিসি, ইউনাইটেড, দিশারী, নিউভিশন, সুপার সিটিং, শিকড়সহ বিভিন্ন কোম্পানির মিনিবাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলছে। এ ছাড়া গাজীপুর পরিবহন, প্রভাতী, আজমেরীসহ আরও কয়েকটি পরিবহন একই কায়দায় সিটিংয়ের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে যাত্রাবাড়ী-গাবতলী রুটে চলাচলকারী লোকাল মিনিবাসগুলো হঠাৎ করে সিটিং হয়ে গেছে। যখন বিভিন্ন কারণে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে যায় তখন যাত্রীদের দুর্ভোগকে পুঁজি করে লোকাল মিনিবাসগুলোও ‘সিটিং সার্ভিস’ ঘোষণা করে। এমনকি দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায় করতেও দ্বিধা করে না।
কর্মকাণ্ড বেআইনি : বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলেছেন, আইনে ‘সিটিং সার্ভিস’ নামে কোনো সার্ভিসের আদৌ অস্তিত্ব নেই। মোটরযান আইনে ‘সিটিং’ নামে আলাদা কোনো বাস চলবে এমন চিন্তা করে ভাড়া নির্ধারণ করা নেই। ভাড়ার তালিকা সব সার্ভিসের ক্ষেত্রেই এক রকম। পরিবহন মালিকরাই নিজেদের স্বার্থে সিটিং সার্ভিস করেছেন। মোটরযান আইনে কেবল ৫২ আসনের বাস এবং ২৯ আসনের মিনিবাস- এ দুই ধরনের বাসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মালিকরা এ আইনের তোয়াক্কা না করে নিজেরাই ইচ্ছা মাফিক ভাড়া নির্ধারণ করছেন। বিকল্প সিটি সার্ভিসের একজন মালিক জানান, যাত্রীরা সব সময় দ্রুত গন্তব্যে যেতে চায়। তাদের সুবিধার্থেই সিটিং সার্ভিস করা হয়েছে। এতে যাত্রীরাই উপকৃত হচ্ছেন।
অভিযোগ শোনার কেউ নেই : অনিয়ম দূর করা দায়িত্ব যাদের, তাদের নাকের ডগায় এভাবে অনিয়ম ঘটছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএতে যাত্রীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থাই নেই। তারা মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার উদ্যোগ নিলেও পুলিশি সহযোগিতার অভাবে সেটা কার্যকর হয় না। মালিক সমিতি নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে বেপরোয়া। পুলিশও প্রায় সব ক্ষেত্রেই নির্বিকার থাকে।  বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নগর পরিবহনের নৈরাজ্য রোধে যাত্রীদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটিতে (মেট্রো আরটিসি) যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। পরিবহন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নগর পরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর