বুধবার, ৬ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

পাচারের ভয়ঙ্কর ৫০ পয়েন্ট

কক্সবাজারে ৭ শতাধিক দালাল চক্রের নেটওয়ার্ক

কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলের ৫০টি পয়েন্ট দিয়ে ভয়ঙ্কর আদম পাচার অব্যাহত রয়েছে। এই পাচার চক্রে জড়িত রোহিঙ্গাসহ সাত শতাধিক স্থানীয় ও বহিরাগত দালাল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা-কর্মীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় প্রতিদিন সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রা করছে অসংখ্য মানুষ। এতে বিদেশগামীরা নিখোঁজ, কারাবন্দী বা দালাল কর্তৃক জিম্মি অবস্থায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নির্যাতনে করুণ মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। জানা গেছে, সংগঠিত দালাল চক্রের কারণেই বন্ধ হচ্ছে না মানব পাচার। ফলে স্বজনহারা পরিবারগুলোর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে এলাকার পরিবেশ। সূত্র জানায়, আদম পাচারকারী সিন্ডিকেটের টার্গেট কর্মক্ষম যুবক, নারী ও শিশু। এই চক্রের সদস্যরা নামেমাত্র অগ্রিম টাকায় বাংলাদেশিদের পাচার করছে প্রতিনিয়ত। পাশাপাশি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে রোহিঙ্গাদেরও বাংলাদেশি বানিয়ে পাচার করছে। সম্প্রতি টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালী, জাহাজপুরা, টেকনাফ সদর, শাহপুরীর দ্বীপ  ঘোলা পাড়া, পশ্চিম পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, জেটিঘাট, কাটাবনিয়া, মিটা পানির ছড়া, রাজার ছড়াসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রা বেড়েছে। তা ছাড়া উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং, ইনানী, হিমছড়ি, রেজুখাল, শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরারটেক, খুরুশকুল, চৌফলদণ্ডি, পোকখালী হয়েও নিয়মিত মানব পাচার হচ্ছে। এ কাজে জড়িত রয়েছে পুলিশ ও প্রভাবশালী কিছু রাজনৈতিক নেতা। এ বিষয়ে জেলার মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বেশ কয়েকবার আলোচনা হলেও কোনো সুফল আসেনি। এদিকে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আটকে রাখা বন্দীদের গণকবরের খবর ছড়িয়ে পড়ায় টেকনাফের কয়েকটি গ্রামে শোকের মাতম চলছে। দীর্ঘদিন নিখোঁজদের স্বজনরা এখন দিশাহারা। নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের তালিকা ধরে খোঁজা শুরু করেছে এমন খবরে স্থানীয়  দালালরা  গ্রাম ছেড়েছেন। রাজনৈতিক ছত্রছায়া আর স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে সাগরপথে মানব পাচার। টেকনাফ-উখিয়া রুটে মানব পাচারে জড়িত প্রায় ১০০ সিন্ডিকেট। পুলিশ প্রশাসনও হন্যে হয়ে খুঁজছে এসব দালালদের। টেকনাফ থানায় দায়ের করা পুলিশের ১৫ মামলার এজাহার থেকে এসব সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু মালয়েশিয়া নয়, থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়া যেতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। তারা ঘরবাড়ি, জমিজমা বিক্রি করে টাকা তুলে দিচ্ছেন দালালদের হাতে। যাত্রাপথে ধরা পড়ে অনেকে জেলও খাটছেন। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মারা যাচ্ছেন কেউ কেউ। হাজারো মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হলেও ধরা পড়ছে না মানব পাচারে জড়িত মূলহোতারা। সূত্র জানায়, গত এক বছরে মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া মানুষের মধ্যে কয়েকশ এখনো নিখোঁজ রয়েছে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেছেন, আদম পাচারকারীদের কোনো সময়ের জন্যে ছাড় দেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে অনেক গডফাদার ধরাও পড়েছে। সঠিক তথ্যের ভিক্তিতে পাচারকারীদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
থাই সীমান্তে বেচাকেনার হাট, মৃত্যুর হাতছানি : রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের এক আস্তানায় হাত-পা ভেঙে, দেহের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ভিক্ষুক বানানোর রোমহর্ষক ঘটনাকেও হার মানিয়েছে মানব পাচারকারীদের বর্বরতার বিভীষিকা। দিনের পর দিন অনাহারে রেখে, নির্যাতন চালিয়ে, পায়ে শিকল বেঁধে মধ্য সমুদ্রে মাছ ধরতে পাঠানোর মতো নানা বর্বরতা চালানো হয় পাচারের শিকার মানুষদের ওপর। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ভয়াল পরিস্থিতিতেও নৌকার সঙ্গে শিকল বাঁধা অবস্থায় থাকতে বাধ্য করা হয়। পাচারকারীরা তাদের শিকার মানুষদের মুক্তিপণের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত নিজেদের হেফাজতে রাখে। এ সময় সমুদ্রপথই হয় তাদের আস্তানা। মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার পর এসব মানুষকে থাই সীমান্তে নিয়ে অন্য পাচারকারী গ্রুপগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়। আর মুক্তিপণের টাকা না পেলে যাত্রীদের মারধর করে অজ্ঞান অবস্থায় থাইল্যান্ড উপকূলের ওর্যাং ডং অঞ্চলের জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশের পাঠানো এক প্রতিবেদনেও নানা বীভৎসতার কথা তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাচারকারীরা ট্রলারে তোলার পরপরই যাত্রীদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন শুরু করে। যাত্রীদের ১৫ দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত সাগরে ট্রলারে ফেলে রাখা হয়। সে সময় খুবই সীমিত পরিমাণ শুকনো খাবার দেওয়া হয়। দুই-তিন দিন পর পর তাদের ভাগ্যে যৎসামান্য খাবার জুটলেও নির্যাতন নিপীড়ন হয় তাদের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী। গত ৯ মার্চ হামিদ করিম নামে মিয়ানমারের এক দালালসহ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ মানব পাচার চক্রের তথ্য উদঘাটন করে। এই চক্র দেশজুড়ে তাদের নিজস্ব এজেন্টের মাধ্যমে ৪০ জেলা থেকে পাচারের জন্য লোক সংগ্রহ করে থাকে। পুলিশ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৪ সালে এই দালাল চক্র দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ২০ হাজার লোককে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড পাচার করে।
থাই সীমান্তে আদম বেচাকেনার হাট : কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল দিয়ে সমুদ্রপথে মানব পাচারকালে নির্যাতন, অপহরণ, ডাকাতি, লুটপাট, খুন ও প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। দেশের সমুদ্র উপকূল দিয়ে লোকজনকে ট্রলারে তুলে থাইল্যান্ড সীমান্তে নিয়ে বন্দী করে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে অন্য দালাল চক্রের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে হরহামেশা। দাবিকৃত অর্থ দিতে না পারলে কঠিন নির্যাতনে হত্যা করে গহিন বনে লাশ ছুড়ে ফেলা হয়।
মানব পাচারে যুক্ত মিয়ানমারের নৌ ও কোস্টগার্ড : ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ২৪১ দালালের নিয়ন্ত্রণে চলছে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল দিয়ে মানব পাচার। ২০১৪ সালে এই দালাল চক্র দেশের ৪০ জেলার ৬০টি পয়েন্ট দিয়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচার করেছে। চাকরি দেওয়ার নাম করে এসব মানুষকে সমুদ্রপথে নৌকায় করে বিদেশ পাচার করে একটি চক্র। পথে নৌকায় চালানো হয় বিভিন্ন নির্যাতন। আবার অনেককে ওই এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্প গেড়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন ও খাবারের অভাবে অনেকে সমুদ্রপথেই মারা যান। সমুদ্রে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ নৌকা থেকে সাগরেই ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। অন্যদিকে থাই সীমান্তের বনের ভিতরে গড়ে তোলা ক্যাম্পে যাদের মৃত্যু হয় তাদের সেখানেই মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়।

 

সর্বশেষ খবর