বুধবার, ৬ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভেস্তে যাচ্ছে বিটিসিএলের আধুনিকায়ন প্রকল্প

কাজে লাগাতে পারল না জাইকার ঋণ

ভেস্তে যাচ্ছে বিটিসিএলের আধুনিকায়ন প্রকল্প

পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ আর দীর্ঘসূত্রতায় প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) আধুনিকায়ন প্রকল্প। বিটিসিএলের সঙ্গে কাজ পেতে আগ্রহী একটি কোম্পানির পারস্পরিক বিবাদ এবং অভিযোগের কারণে বারবার ভেস্তে গেছে প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়া। অন্যদিকে এই টেন্ডার জটিলতায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হওয়ায় প্রকল্পের এক অংশের কাজ শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এর মেয়াদ। ইতিমধ্যে বিভিন্ন অনিয়ম-অভিযোগ ও দীর্ঘসূত্রতায় ক্ষুব্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও বিটিসিএলকে চিঠি দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। এর আগে বিটিসিএল-এর পক্ষ থেকে কয়েক দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করা হলেও জাইকা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, তারা আর কোনোভাবেই সেটি করতে পারবে না। বিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালের জুনে বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার মধ্যে ৮.০৪ বিলিয়ন ইয়েনের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং শর্তানুযায়ী বিটিটিবি, বিটিসিএল এ রূপান্তরিত হলে ২০০৮ সালের জুলাইয়ে তা কার্যকর হয়। সম্পূর্ণ জাইকার অর্থায়নে বিটিসিএলকে 'টেলিকমিউনিকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প' বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের দুটি অংশ। প্রথমটি একচেঞ্জ, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি স্থাপন (লট-এ) এবং অপরটি সারা বাংলাদেশে ট্রান্সমিশন ব্যাকবোন তৈরি (লট-বি)। অভিযোগ উঠেছে, আগামী ২ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চললেও এখনো পর্যন্ত শেষ হয়নি লট-এ অংশের কাজ। এই অংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি কাজ শেষ করতে না পারলেও শেষ সময়ে কাজ দেখিয়ে দ্রুত জাইকার কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা করছে বিটিসিএল। যদিও গতকাল বিটিসিএল-এর প্রকল্প পরিচালক অশোক কুমার মণ্ডল জানান, লট-এ এর ৯৬ শতাংশ কাজই সম্পন্ন হয়েছে। বাকি এক মাসের মধ্যে শেষ কাজটুকুও সম্পন্ন হয়ে যাবে। অন্যদিকে এই প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বিটিসিএল-এর ঊর্ধ্বতন ৫-৭ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মূল্য পরিশোধের মুদ্রা জাপানি ইয়েন থেকে ডলারে পরিবর্তন এবং এর বিপরীতে ইয়েনের ক্রমাগত বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে ১০০ কোটি টাকা ক্ষতির যে অভিযোগ উঠে তা গতকাল নাকচ করে দেন সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তারা। ডলারে রূপান্তরিত করায় সরকারের ক্ষতি নয়, বরং লাভ হয়েছে উল্লেখ করে জাইকার গাইড লাইনে এটির বৈধ আছে বলে প্রমাণ দেখান। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, অনিয়ম এবং পারস্পরিক দোষারপের কারণে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হওয়ায় গত চার বছরেও একই প্রকল্পের লট-বি অংশের কাজ শুরু সম্ভব হয়নি। কাজ পেতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান নেটাসের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সময় থেকেই একজন দরদাতার পক্ষে কাজ করতে গিয়ে আরেক প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিতে মূল্যায়ন প্রতিবেদনেই জালিয়াতি করা হয়। এমনকি সরকারের রিভিউ প্যানেলে তা প্রমাণিত হলে সেটি 'অসঙ্গত কার্য' হিসেবে রায়ে লিপিবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে বিটিসিএল এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট ও পরবর্তীতে সুপ্রিমকোর্টে আপিল দাখিল করে। কিন্তু দুই জায়গাতেই তারা পরাজিত হয়। এরপর বিটিসিএল আবারও প্রাক্কলন দেখিয়ে জাইকার কাছে পুনঃদরপত্রের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু সেই প্রস্তাব 'যুক্তিসঙ্গত' না থাকায় জাইকা ঋণ চুক্তি ও গাইডলাইন অনুযায়ী দরপত্র কমিটির প্রতিবেদন ও সুপারিশ গ্রহণ করে গত ১৮ ডিসেম্বর তাদের অনাপত্তি প্রদান করে। এভাবে একের পর এক জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে গত জানুয়ারির ১৮ তারিখে বিটিসিএলকে, ২২ তারিখ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি ইআরডিকে চিঠি দেয় জাইকা। চিঠিতে জাইকার পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা আর কোনোভাবেই ঋণ চুক্তির মেয়াদ আগামী ২ জুন থেকে বাড়াবে না।

এদিকে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মাত্র ৪১ শতাংশ ঋণ ব্যবহৃত হয়েছে। আর সে হিসাবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, জাইকা তার ঋণ চুক্তির মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অটল থাকলে বাকি ৫৯ শতাংশ ঋণও (প্রায় ৪.৭৪ বিলিয়ন ইয়েন বা ৩০৫ কোটি টাকা) ফেরত চলে যাবে। সেই সঙ্গে কোটি কোটি টাকা না পাওয়ার কলঙ্ক নিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সরকারের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। এ ছাড়া জাইকার সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। তবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেছেন এ পর্যন্ত তারা ৬৫ শতাংশ ঋণ ব্যবহার করতে পেরেছে। এ প্রসঙ্গে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহফুজ উদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টেন্ডারে নেটাস যে মূল্য দাবি করে তা আমাদের স্টেমিটেড কস্ট (প্রাক্কলিত ব্যয়)-এর চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি হওয়ায় দরপত্র মূল্যায়ন বোর্ড নেটাসকে বাদ দিতে বাধ্য হয়। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে জাইকাকে আবারও চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদি তারা একান্তই না বাড়াতে চায় সেক্ষেত্রে আমরা অন্য একটি প্রকল্প থেকে টাকা বাঁচিয়ে আমাদের নিজেদের টাকায় পুনঃদরপত্র আহ্বান করে এই দামের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করব।

দরপত্র জালিয়াতিসহ যাবতীয় অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সেগুলো সম্পূর্ণ নাকচ করে দেন এই কর্মকর্তা।

 

সর্বশেষ খবর