শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
মালয়েশিয়ায় মানব পাচার

সাগরপথে নিশ্চিত মৃত্যু তবুও ছুটছে মানুষ

সাগরপথে মালয়েশিয়া যাত্রায় নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মানুষ থামছে না। শত শত মানুষ ছুটছে প্রতিনিয়ত। কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলের অসংখ্য পয়েন্ট দিয়ে জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ট্রলারে চেপে বসছেন তারা। উত্তাল সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। মালয়েশিয়াগামী এসব মানুষ দালালের খপ্পরে পড়ে সহায়সম্বল এমনকি বসতভিটা পর্যন্ত বিক্রি করে সর্বহারা হয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ আবার ট্রলারেই মারা যাচ্ছেন। কখনো থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানের অনেক পরিবারে স্বজন হারানোর শোক এখনো শুকায়নি। এরপরও মানুষ ছুটছে সাগরপথে মালয়েশিয়ায়। কক্সবাজার সদরসহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক পরিবার রয়েছে যাদের কেউ না কেউ সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রা করেছেন। তাদের আর কোনো খবর নেই। সম্প্রতি থাইল্যান্ডে গণকবরে বাংলাদেশিদের লাশের খবরে সারা দেশে তোলপাড় চলছে। নিখোঁজ অনেক পরিবারে বিরাজ করছে মাতম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের ঘটনাটি পুরোটাই প্রলোভন ও প্রতারণা। অবৈধ অভিবাসীরা পথে পথে নির্যাতন-নিপীড়ন ও ভোগান্তির শিকার হন। এদিকে দালালরা নির্ধারিত টাকা আদায়ের পর তাদের তুলে দেন থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পুলিশের হাতে। আর যারা টাকা দিতে ব্যর্থ হন, তাদের নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে দালাল চক্র। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ শেষে ইতিমধ্যে অনেকেই দেশে ফিরেছেন। থাইল্যান্ডে এক বছর কারাভোগ শেষে দেশে ফিরেছেন কক্সবাজারের রামু উপজেলার কাউয়ারকোপ ইউনিয়নের লট উখিয়ারঘোনা এলাকার আমির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ ফোরকান। তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের জানুয়ারিতে স্থানীয় এক নারী দালালের মাধ্যমে টেকনাফ হয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হই। টেকনাফের কচুবনিয়া থেকে একটি ডিঙিতে তুলে দেওয়া হয় আমাকে। এক রাত পর মিয়ানমার সীমান্তবর্তী একটি বড় কাঠের ট্রলারে তোলা হয়। ওই ট্রলারে আগে থেকেই লোকজন ছিল। ট্রলারটিতে টানা পাঁচ দিন অবস্থানকালে অস্ত্রধারীরা আমাদের ওপর নির্যাতন চালায়। তারপর থাইল্যান্ডের পাহাড়ে নিয়ে যায় পাচারকারীরা। সেখানে এক-দুই দিন পরপরই তারা আস্তানা পরিবর্তন করে। সর্বশেষ নিয়ে যাওয়া হয় একটি সয়াবিন বাগানে। সেখানে মোবাইল ফোনে পরিবারের সঙ্গে কথা বলায় পাচারকারীরা। এ সময় আমি বাবাকে বলি, ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিলে আমাকে মালয়েশিয়ায় পাঠাবে তারা। আমার আকুতি শুনে বাবা অনেক কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে টেকনাফের এক ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করেন।’ ফোরকানের বাবা আমির হোসেন জানান, টাকা দেওয়ার পরই তার ছেলেকে থাই পুলিশে সোপর্দ করে দালালরা। তিনি দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। ফোরকানের মতো একই পরিণতি হয়েছে রামুর মেরুংলোয়া এলাকার মোতাহের আলীর ছেলে শাকেরুল ইসলামের, উত্তর মিঠাছড়ির নুর আহমদের ছেলে রমজান আলী ও টেকনাফের লেঙ্গুর বিল এলাকার মোজাহার মিয়ার ছেলে শামসুল আলম সৌরভের। সাজাভোগ শেষে ফেরা এসব যুবককে স্বনির্ভর করতে নানাভাবে সহায়তা দিয়ে চলা বেসরকারি সংস্থা ইপসার একজন কর্মকর্তা জানান, গত এক বছরে কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে অসংখ্য বাংলাদেশি পাচার হয়েছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ শেষে এক বছরে কক্সবাজারে ফিরেছেন ১০০ জন। জানা গেছে, গত তিন বছরে সাগরে ট্রলারডুবিতে পাঁচ শতাধিক মালয়েশিয়াগামী মারা গেছেন। নিখোঁজ রয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। পাচারকারীর গুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন মালয়েশিয়াগামী। তার পরও কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া গমন।
মানব পাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধানকেও পাচারকারীরা গায়ে মাখছে না।
 উল্টো দিনে দিনে বেপেরোয়া হয়ে উঠেছে মানব পাচারকারী চক্র। নানা কৌশলে তারা প্রতিদিনই মানব পাচার অব্যাহত রেখেছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যমতে, মানব পাচারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র জড়িত রয়েছে। এরা দেশের বাইরে অবস্থান করে পাচার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া অবৈধ পথে মালয়েশিয়াগামী লোকজন উদ্ধার হলেও তাদের কাছ থেকে দালালদের সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এর ফলে মানব পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তাই পাচারও ঠেকানো যাচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর