বুধবার, ২৭ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

যৌন সন্ত্রাসের ৩০০ স্পট

* ভয়ঙ্কর অপরাধ আখড়া কুড়িল বিশ্বরোড
* ঢাকায় আট মাসে ৯ তরুণী প্রাণ হারিয়েছে

রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড মোড় এলাকা এখন ভয়ঙ্কর অপরাধ আখড়া। সন্ধ্যা পেরোতেই নেশাখোর মাতাল, মাস্তান, পকেটমার, ছিনতাইকারী, অস্ত্রবাজ ডাকাত চক্রের মিলনমেলায় পরিণত হয়। দৃষ্টিনন্দন ফ্লাইওভারকে কেন্দ্র করে চারপাশেই অবৈধভাবে গড়ে তোলা কয়েকশ দোকানপাট, মোটর গ্যারেজ, ঝুপড়ি-বস্তি, ক্লাব, হোটেল ঘিরে চলে জমজমাট আড্ডাবাজি। এখানে-সেখানে বসে মদের আড্ডা, জুয়ার আসর। মাদক বিক্রেতাদের ছোটাছুটি, কেনাবেচায় রাতভর সরগরম থাকে কুড়িল। বিমানবন্দরকেন্দ্রিক চোরাকারবারি নানা গ্রুপেরও সরব অবস্থান থাকে সেখানে। আনাগোনা করে আশপাশের এলাকায় অবস্থানকারী আফ্রিকান নিগ্রো যুবকেরা। মহাখালী-এয়ারপোর্ট-টঙ্গী রুটের পকেটমার চক্রের কথিত সরদার ইয়াকুব ও জনি গ্রুপের শক্ত ঘাঁটি কুড়িলে। রূপগঞ্জ, গাউছিয়া মার্কেট ও নরসিংদী এলাকার চিহ্নিত ডাকাত চক্রের সদস্যরা প্রায়ই শিকারের সন্ধানে ওতপেতে থাকে ফ্লাইওভারের বিভিন্ন প্রান্তে। বহুমুখী অপরাধী চক্রের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল গাড়িরও অবস্থান থাকে কুড়িলে। কিন্তু ফ্লাইওভার এলাকাটি ভাটারা, খিলক্ষেত ও ক্যান্টনমেন্ট থানার মোড় হওয়ায় ‘থানা সীমানা চিহ্নিতকরণ’ নিয়ে আছে জটিলতা। বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস, মিনিবাস, লেগুনা, সিএনজি অটোরিকশার অঘোষিত টার্মিনাল বানানোর কারণে কুড়িল হয়ে উঠেছে আরও বিপদসংকুল এলাকা। কয়েকশ পরিবহন শ্রমিকের অবস্থান, দাপুটে নিয়ন্ত্রণ, হৈচৈ মিলিয়ে সীমাহীন অস্বস্তিকর পরিবেশ। সেখানে হররোজ ঘটে নারী নিগ্রহের ঘটনা। ইভ টিজিং, বখাটেপনা, টানাহেঁচড়া, মাতলামির নিরাপদ স্থান। কুড়িল হয়েই প্রতিদিন বিভিন্ন রুটের বাস-মিনিবাস, সিএনজি অটোরিকশা, রিকশায় কয়েক হাজার মানুষের আসা-যাওয়া। আশপাশের ১১টি গার্মেন্ট কারখানার হাজারো নারীকর্মীদেরও যাতায়াত করতে হয় কুড়িল পেরিয়ে। যে কোনো বয়সের নারী চোখ-মুখ বুজে কুড়িল মোড় এলাকা পেরোতে পারলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে কুড়িলের এ মোড় থেকেই এক গারো তরুণী অপহরণের ঘটনা ঘটে। পাঁচ লম্পট তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে পাশবিক নির্যাতন চালায়। ওই ঘটনার দুই দিন আগে আরেক নারীকে টানাহেঁচড়ার ঘটনা ঘটে কুড়িলে। আশপাশের লোকজন এগিয়ে যাওয়ায় বেসরকারি ব্যাংকের সেই নারীকর্মী রক্ষা পান।
রাজধানীতে কুড়িলের মতো অন্তত ৩০০ পয়েন্টে নারীরা যৌন সন্ত্রাসের শিকার হন। সেসব স্থানে হরদম থাকে বখাটে মাস্তানদের আনাগোনা। নানারকম উৎপাত আর পথচারী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনা ঘটে অহরহ। স্কুল-কলেজগামী ছাত্রী, গার্মেন্ট কর্মী, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী নারী- কারও রেহাই নেই। পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোও এখন আর নিরাপদ নয়। যৌন হয়রানি, উৎপাত, অশালীন-নাজেহালের মাত্রা মাঝেমধ্যেই এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, আত্মহননের ঘটনাও ঘটে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গত ৮ মাসে অন্তত ৯ জন কিশোরী-তরুণী প্রাণ হারিয়েছে। বখাটেপনার মুখে অর্ধ শতাধিক শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবাদ করতে গেলে নানা হয়রানিসহ হামলা ও নৃশংসতার শিকার হতে হয়। পাড়া-মহল্লা, রাস্তাঘাট আর মার্কেটেই শুধু নয়, মেয়েরা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল এমনকি হাসপাতালেও যৌন সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন। সার্বজনীন অনুষ্ঠানাদিতেও পরিবার-পরিজন নিয়ে নারীদের অংশ নেওয়ার উপায় থাকছে না। ১ বৈশাখ বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে টিএসসি এলাকায় সংঘটিত নজিরবিহীন যৌন হয়রানির ঘটনায় সর্বত্রই ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। ভুক্তভোগী মেয়েদের অভিভাবকসহ বিশিষ্টজনরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত চালুর তাগিদ দিয়েছেন। নারী নিপীড়নে নতুন নতুন মাত্রাও যোগ হচ্ছে। প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে বা ভয়ভীতির মুখে মোবাইল ফোনসেটে নগ্ন ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করে প্রতারণাসহ চালানো হচ্ছে চাঁদাবাজি। বখাটেদের চাহিদামাফিক টাকা-পয়সা নিয়মিত না দেওয়া হলেই আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার কথা ভেবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নেন না। অনেক ক্ষেত্রে মামলা করলেও পুলিশের কাক্সিক্ষত সহায়তা মেলে না।
বখাটের উৎপাতে গত ১৯ জানুয়ারি আত্মহননের পথ বেছে নেয় শ্যামলী আইডিয়াল টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী নাসফিয়া আকন্দ পিংকি (১৪)। ৩ এপ্রিল খিলগাঁও এলাকায় নবম শ্রেণির ছাত্রী উম্মে কুলসুম ইলোরা আত্মহত্যা করে। দক্ষিণখানে আফসানা আক্তার লাভলি (১৭) নামে এক গার্মেন্ট কর্মী বিষপানে আত্মহত্যা করে। গত বছর ২ নভেম্বর তার করুণ এ মৃত্যুর পরও বখাটে আসামিরা বুক ফুলিয়ে বিচরণ করছে এলাকায়। পল্লবীতে ১৬ এপ্রিল জামেনা আক্তার (১৫) নামে এক মাদ্রাসাছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। যাত্রাবাড়ীতে ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় ব্যবসায়ী মামুন হাওলাদারকে (২৫) পিটিয়ে হত্যা করে বখাটেরা। মুগদা এলাকার উত্তর মান্ডায় গত ২৪ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করে সাদিয়া (১৪) নামে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী। সিদ্ধিরগঞ্জে গত ১৯ মে আত্মহত্যা করেছেন এক গৃহবধূ। অভিযুক্ত মো. জালাল উদ্দিনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত বছর ৬ নভেম্বর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সাদিয়া সালাম শিপুন (১১) নামে ষষ্ট শ্রেণির এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে। খিলগাঁও এলাকায় গত ২৪ মে তমা আক্তার (১৪) নামে এক স্কুলছাত্রী ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
একটি মানবাধিকার সংগঠনের জরিপ সূত্রে জানা যায়, গত চার বছরে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে ৯৯ নারী আত্মহত্যা করেছে। যৌন হয়রানিতে বাধা দেওয়ায় লাঞ্ছিত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি নারী ও ৪৮৯ জন পুরুষ। ১১ থেকে ১৫ বছরের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
বখাটেপনা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা রাজধানীর কয়েকটি ওভারব্রিজে উঠে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেই টের পাওয়া যায়। বখাটেরা দল বেঁধে এসব ওভারব্রিজের রেলিংয়ে উঠে বসে থাকে। ব্রিজ পারাপাররত তরুণীদের উদ্দেশ্য করে নানা ধরনের অশ্লীল গলার আওয়াজ করা থেকে শুরু করে ওড়না পর্যন্ত টেনে ধরা হয়। কমলাপুর রেলওয়ে ওভারব্রিজে প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করেছেন আশপাশের মানুষ। ইদানীং উঠতি বয়সী তরুণরা মোটরসাইকেলে ডিজিটাল হর্ন ব্যবহারের মাধ্যমেও স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করছে। ‘এই মেয়ে একটু দাঁড়াও, রাগ করো না প্রেম দাও, সব জানি তোমার’ ইত্যাদি সব কথাবার্তা রেকর্ড করে তা ডিজিটাল হর্ন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকে মেয়েদের নাম উল্লেখ করেও ডিজিটাল হর্ন রেকর্ড করে থাকে। এ নিয়ে অনেক তরুণী ও তাদের অভিভাবক চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন।

সর্বশেষ খবর