বুধবার, ২৭ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
শোচনীয় শিক্ষা ব্যবস্থা (৮)

শিক্ষাজীবনেও মাদকের ছোবল

শিক্ষাজীবনেও মাদকের ছোবল

মাদকবিষে জর্জরিত হয়ে শেষ হচ্ছে বহু মেধাবীর জীবন। শিক্ষাজীবন ছেড়ে অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে মেধাবীরা। অকালেই ঝরে পড়ছে জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা। স্কুল থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত চলছে মাদকের ভয়াল আগ্রাসন। শুধু সেবন নয়, রমরমা বাণিজ্যের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। আর এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার ওপর।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মাদকের রূপ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করলে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মাধ্যমে ৩৪টি পাবলিক ও ৭১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে মাদক নিয়ন্ত্রণে কমিটি গঠনের মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বলা হয়, কমিটি শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মাদক সেবন থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট হবে। এ ছাড়া ওই সময় মাদক নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসি ক্যামেরা বসানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের এ নির্দেশনা কোনো কাজেই আসেনি। বরং দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে মাদকের আগ্রাসন। সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাদকসংশ্লিষ্টতার ঘটনা সেই ভয়ঙ্কর চিত্রকেই তুলে ধরে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বর্তায়। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রক্টরিয়াল বডিও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে। কারও বিরুদ্ধে মাদক বা ইয়াবা ব্যবসায়ের অভিযোগ পেলে প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।’ ইউজিসির নির্দেশনা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলাদাভাবে কমিটি গঠন না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কাউন্সেলিং বিভাগ রয়েছে সেখানে নিয়মিতভাবেই মাদক নিরাময়ে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং বা অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য যে কোনো বিভাগের তুলনায় চারুকলা, নাট্যকলা এবং সংগীত বিভাগে মাদক গ্রহণের প্রবণতা অনেক বেশি। এ বিভাগগুলোয় অনেকটা খোলামেলাভাবেই মাদক সেবন ও কেনাবেচা চলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থীর ভাষ্য, ‘একটু আধটু সিগারেট কিংবা গাঁজা না খেলে পেইন্টিংয়ের মতো সৃষ্টিশীল কাজ করা যায় না। তা ছাড়া গাঁজার উপকারিতা বিষয়ে অনেক বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখাও রয়েছে।’ এসব বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থীই এ ধরনের মন্তব্য করেছেন। শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকরাও মাদক সেবন করেন। রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় চলে রমরমা মাদক ব্যবসা। ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল থেকে শুরু করে মদ-গাঁজা পর্যন্ত সব কিছুই পাওয়া যায় ক্যাম্পাসে। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে ইয়াবা ও মদ সেবনের প্রবণতা বেশি। জানা গেছে, ইয়াবা ব্যবসার অন্যতম জমজমাট কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় সর্বনাশা এই মাদক। কোনো কোনো স্থানে প্রকাশ্যেই চলে বেচাকেনা। ইয়াবার ভয়ঙ্কর থাবা এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে আবাসিক হল, ক্লাসরুম, চা ও পান-সিগারেটের দোকানেও পাওয়া যায়। বাদ যাচ্ছে না ছাত্রী হলও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও ইয়াবায় আসক্ত একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, শুধু খুচরা কেনাবেচা নয়, ক্যাম্পাস এখন এ মাদকের গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। গত কয়েক সপ্তাহে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইয়াবার চালানসহ আটক হয়েছেন ১০ জনেরও বেশি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও একই। ক্যাম্পাসের চারুকলা বিভাগ, মেহেরচণ্ডী ও স্টেশনবাজার এলাকায় চলে মাদকের অবাধ বাণিজ্য। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিকবার শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদক সেবনের অভিযোগ পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পথে-ঘাটে-পুকুরে পড়ে থাকে দেশীয় ফেনসিডিলের বোতল। ক্যাম্পাসসংলগ্ন আনারকলি বাজার, নবীনগর বস্তি ও আশপাশ এলাকায় কেনাবেচা হয় এই মাদক। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবাধেই চলছে মাদক। শুধু সরকারি-বেসরকারি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, মাদকের ভয়ঙ্কর থাবায় কলঙ্কিত হচ্ছে স্কুলশিক্ষার্থীরাও। সেখানে অপ্রাপ্তবয়সীরাও যোগ দিচ্ছে মাদক সেবনে।
ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উঠতে না উঠতেই প্রথমে সিগারেট এবং পরবর্তীতে আরো ভয়ঙ্কর নেশার পথ ধরছে। ঝরে পড়ছে বহু শিক্ষার্থী। অল্প বয়সেই মাদক ছাড়াও অন্যান্য অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে তারা। সমাজে ঘটছে ‘ঐশী ট্র্যাজেডি’র মতো ভয়ঙ্কর সব ঘটনা। এ অবস্থায় কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে নয়, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের জন্য আলাদা বিভাগ গঠনের পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিজ্ঞানীরা। একই সঙ্গে অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার কথা বলছেন তারা।

সর্বশেষ খবর