বৃহস্পতিবার, ৪ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা
ওষুধ শিল্পে নৈরাজ্য (৫)

ওষুধ নীতি আধুনিকায়ন হয়নি ৩৩ বছরেও

ওষুধ নীতি আধুনিকায়ন হয়নি ৩৩ বছরেও

তিন দশকের বেশি পুরনো নীতিমালা দিয়ে চলছে দেশের বিকাশমান ওষুধশিল্প। গত কয়েক বছরে এ শিল্প দ্রুত বিকশিত হলেও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওষুধনীতির আধুনিকায়ন করা হয়নি। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেশীয় বাজারে নকল, ভেজাল ও নিুমানের ওষুধ সহজে ঠাঁই করে নিচ্ছে। রোধ করা যাচ্ছে না লাগামহীন উচ্চমূল্য। পুরনো নীতিমালার বাধ্যবাধকতায় ওষুধের মান ও কার্যকারিতা নিয়েও ক্রেতারা কোনো তথ্য জানতে পারছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যুগোপযোগী নীতিমালা না থাকায় দেশজুড়ে ওষুধ বাণিজ্যে চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য। ওষুধশিল্প নিয়ন্ত্রণে ১৯৮২ সালে সর্বশেষ আইন করা হয়। এরপর দীর্ঘ ৩৩ বছরে এ শিল্প আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ দেশের ৯৮ ভাগ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ববাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১০৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে ওষুধ। কিন্তু একটি আধুনিক ওষুধনীতি বাস্তবায়নের কাজ তিন দশকের বেশি সময় পরও শেষ হয়নি। সূত্র জানায়, ওষুধনীতি আধুনিকায়নে দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সরকার উদ্যোগ নিলেও প্রভাবশালীদের চাপে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ ২০০৫ সালে একটি জাতীয় ওষুধনীতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে জাতীয় ওষুধনীতির একটি খসড়া প্রস্তুত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ওষুধনীতির খসড়া প্রস্তুত কমিটির এক সদস্য জানান, ওষুধের নকল, ভেজাল ও উচ্চমূল্য রোধ, কাঁচামালের উৎপাদন ও আমদানি সহজ করতে যুগোপযোগী ওষুধনীতি প্রয়োজন। ওষুধ খাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি রোধ এবং ভোক্তাদের স্বার্থের বিষয়টি সামনে রেখেই নতুন ওষুধনীতির খসড়া তৈরি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওষুধনীতি আধুনিকায়নের বিষয়টি মন্ত্রণালয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। ইতিমধ্যে ওষুধশিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। তাদের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শিগগিরই নতুন ওষুধনীতি বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানা গেছে। ওষুধনীতির খসড়া হাতে পাওয়ার পর মন্ত্রণালয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি আইনের বিভিন্ন ধারা ও অনুচ্ছেদ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। তবে খুব শিগগিরই নতুন ওষুধনীতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য কাজ করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায়, ১৯৮২ সালে যে বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপটে ওষুধনীতি করা হয়েছিল দীর্ঘ ৩৩ বছর পর এসে সে বাস্তবতা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। এই সময়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। ওষুধের দেশীয় বাজার বেড়েছে কয়েক গুণ। ওষুধের উৎপাদন কারখানা, বিনিয়োগ ও ভোক্তা বেড়েছে অনেক। বেড়েছে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতাও। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অব্যবস্থাপনার নানা মাত্রা। এসব প্রেক্ষাপটে দেরিতে হলেও জাতীয় ওষুধনীতি বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কার্যকর ওষুধনীতির অভাবে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা চড়া দামে ওষুধ বিক্রি করছেন। বাজারে নকল ও ভেজাল ওষুধও বিক্রি হচ্ছে, যা সেবন করে রোগমুক্তির পরিবর্তে নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। গত কয়েক বছরে ওষুধের দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। কোনোভাবেই ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, ৩৩ বছরের পুরনো ওষুধনীতির কারণেই দেশের ওষুধ বিপণনব্যবস্থা মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ-নির্ভর হয়ে উঠেছে। কারণ, ওষুধনীতির বাধ্যবাধকতার কারণে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের নতুন ওষুধের প্রচারে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে পারে না। ডাক্তারদের উপহার-উপঢৌকন দিয়ে ওষুধ বাজারজাত করতে হয়। কোনো কোম্পানি এ আইন লঙ্ঘন করে ওষুধের বিজ্ঞাপন দিলে শাস্তিস্বরূপ ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির উপসচিব এস এম মনির হোসেন বলেন, নতুন ওষুধনীতি বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। যুগোপযোগী ওষুধনীতি না থাকায় গুটিকয় কোম্পানি লাভবান হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের জনগণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ-প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, নতুন ওষুধনীতি বাস্তবায়ন হলে ওষুধ খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি। দেশে ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ রোধে নিয়মিত বৈঠক করছি।’
নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে সরকার ও ওষুধ কোম্পানিগুলো একসঙ্গে কাজ করবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, ওষুধ হচ্ছে মানুষকে বাঁচানোর মাধ্যম। আর সেই ওষুধ ভেজাল ও নকল করে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া মেনে নেওয়া যায় না। নতুন জাতীয় ওষুধনীতি বাস্তবায়নেও মন্ত্রণালয় কাজ করেছে বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর