বুধবার, ১৭ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা

বহুমুখী সংকটে নার্সিং পেশা ঝুলে আছে নিয়োগ প্রক্রিয়া

দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে চলছে তীব্র নার্স সংকট। এ সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ মহল থেকে বার বার নতুন নিয়োগের কথা বলা হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা হচ্ছে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিলম্বে ১০ হাজার নার্স নিয়োগের নির্দেশ দিলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কারণে সে প্রক্রিয়া ঝুলে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমলাতান্ত্রিকতার জাঁতাকলে পড়ে নার্সরা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু নিয়োগ বিধিমালা তৈরি না করার কারণে একদিকে নার্সরা দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন না, অন্যদিকে তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। একই কারণে নার্সিং পাস প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শূন্যপদে নিয়োগ পচ্ছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি হিসাবে একজন চিকিৎসকের সহায়তার জন্য প্রয়োজন তিনজন নার্স। অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতরের জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে একজন চিকিৎসককে সহায়তা করছেন মাত্র একজন নার্স। ফলে সরকারি হাসপাতালগুলোয় চলছে তীব্র নার্স সংকট। প্রায় সাড়ে তিন হাজার পদ শূন্য আছে। কিন্তু আট হাজার নার্স পাস করেও বেকার বসে আছেন। এর মধ্যে দুই হাজারের বেশি বিএসসি রেজিস্ট্রার্ড নার্স চার বছর মেয়াদি কোর্সে উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগবিধি না থাকার কারণে সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে পারছেন না। জানা গেছে, সেবা পরিদফতরের পরিচালকের পদটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য আছে। এ পদে ১৯৯২ সালের পর থেকে নিয়োগকৃত পরিচালকদের সবাই ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ জন্য কোনো স্থায়ী পদ তৈরি হয়নি। ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সুরাইয়া বেগমের অবসর নেওয়ার পর একই পরিদফতরের উপ-পরিচালক (শিক্ষা) নিলুফার ফরহাদ ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব নেন। তবে তিনি শুধু আর্থিক বিষয়ে সই করতে পারেন। তার কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। যোগাযোগ করা হলে নিলুফার ফরহাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে ১০ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছেন তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দী হয়ে আছে। এ ছাড়া নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পদোন্নতি দেওয়াসহ বেশকিছু সমস্যা এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঝুলে আছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়গুলোয় ছাড় পেতে হবে। তিনি আরও বলেন, নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স ৩৬ হতে হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি না হওয়ায় জট তৈরি হয়েছে। এদিকে নার্স নেতারা ৭ জুন তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নেতারা জানান, প্রধানমন্ত্রী নতুন নার্স নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ আন্তরিক। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এ নিয়োগ হচ্ছে না। বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে সবুজ সংকেত পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মোহাম্মদ জামালউদ্দিন বাদশা বলেন, ‘নিয়োগ বিধিমালা না থাকায় নার্সদের পদোন্নতি হচ্ছে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক, কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোর দ্বন্দ্বের কারণে ধীরগতিতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে। আমরা চাই আমাদের সমস্যা সমাধানে সেবা পরিদফতরে একজন দক্ষ পরিচালক নিয়োগ করা হোক।’
অভিযোগে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে এন্ট্রি পয়েন্টে সিনিয়র স্টাফ নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে উন্নীত করার ঘোষণা দেন। এরপর নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে আত্তীকরণ করা হয়। কিন্তু নতুন নিয়োগে সমস্যা দেখা দেয়। নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ বিধিমালা প্রয়োজন। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ছয় বছরেও সে বিধিমালা তৈরি করতে পারেনি। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী নতুন যে ১০ হাজার নার্স নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন, তা কীভাবে হবে এ নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আর দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার পর নিয়োগবিধি ছাড়াই শূন্যপদ ও অ্যাডহক ভিত্তিতে দুই দফায় ৫ হাজার ৮৪৭ জন নার্সকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগকৃতরা চলতি দায়িত্বে সেবা পরিদফতর ও সাতটি নার্সিং কলেজসহ বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। নিয়োগবিধি না থাকায় বহু সিনিয়র স্টাফ নার্স উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও একই পদে কাজ করছেন। বাংলাদেশ ডিপ্লোমা নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, নার্সিং সুপারভাইজার ও নার্সেস ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক সাবিনা শারমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি হওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। নিয়োগবিধি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা হচ্ছে। অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কারণে নার্সরা তাদের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।’ এদিকে নার্স নেতারা বলছেন, সেবা পরিদফতর থেকে নিয়োগ বিধিমালা তৈরির জন্য প্রস্তাব পাঠানো হলেও কাজ শুরু হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি খসড়া বিধিমালা তৈরি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তাও ফাইলবন্দী হয়ে আছে। সেবা পরিদফতর সূত্রে জানা যায়, পিএইচডি, এমপিএইচ, মাস্টার ইন নার্সিংসহ উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও উপযুক্ত পদমর্যাদা পাননি হাজারো নার্স। এ ছাড়া নার্সিং সুপারভাইজার, পাবলিক হেলথসহ মোট নয়টি ভাগে নার্সদের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেব পদোন্নতি পাওয়ার কথা থাকলেও আমলাতান্ত্রিক কারণে তা হচ্ছে না। একদিকে পদোন্নতি না হওয়া অন্যদিকে বেতন কাঠামো বৃদ্ধি না পাওয়ায় বর্তমান বাজারে নার্সরা যে বেতন পাচ্ছেন তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স ৮ হাজার স্কেলে বেতন পান; যা অত্যন্ত কম। কয়েকজন নার্স এ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে জানান, রাতে ১২ ঘণ্টা কাজ করার পরও তাদের ওভারটাইম দেওয়া হয় না। সন্তানকে বাসায় রেখে, ঝুঁকি নিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারী নার্সরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন; তার পরও তাদের নৈশভাতা নেই। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রায়ই তাদের অসৌজন্যমূলক আচরণ পেতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে নার্সদের সুবিধাগুলো ভোগ করছেন চিকিৎসকরা। বিশেষ করে চিকিৎসক হওয়ার পরও অনেকে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য নার্সিং ট্রেনিং নিচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোয় পদোন্নতির জন্য নার্সদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন ফরম জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। প্রতি বছর নার্সরা ফরমটি জমা দিলেও তা কোনো কাজে আসছে না। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেবা পরিদফতর, নার্সিং কলেজ, ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালগুলোয় গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে অবিলম্বে প্রথম শ্রেণির পদগুলো পূরণ করে এ সেক্টরে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর