বুধবার, ১৭ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা

মিয়ানমারে শনাক্ত আরও ৩৭ বাংলাদেশি

চাপ প্রয়োগের পক্ষে সুজন

মিয়ানমারের জলসীমায় উদ্ধারদের মধ্যে আরও ৩৭ বাংলাদেশিকে শনাক্ত করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এদিকে কক্সবাজারের টেকনাফে অভিযান চালিয়ে সাত মানবপাচারকারী দালালকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টারত হাজার হাজার অভিবাসীর সংকট মোকাবিলায় গতকাল লুক্সেমবার্গে বৈঠক করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা।
বিজিবি মিয়ানমারের জলসীমায় উদ্ধারদের মধ্যে আরও ৩৭ বাংলাদেশিকে শনাক্ত করেছে। এ নিয়ে ২০৮ জনের মধ্যে দুই দফায় ১৮৭ জন বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত হলো। বিজিবির কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এম এম আনিসুর রহমান বলেন, নতুন শনাক্ত ৩৭ জন বাংলাদেশিকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে পতাকা-বৈঠকের মাধ্যমে আজ বা আগামীকাল বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে তাদের ফেরত আনার সম্ভাবনা রয়েছে। ২১ মে মিয়ানমার উপকূলে একটি নৌকা থেকে ২০৮ জনকে উদ্ধারের পর এর মধ্যে ২০০ জন বাংলাদেশি রয়েছে বলে দাবি করে মিয়ানমার। উদ্ধারদের পরিচয় যাচাই-বাছাই করে তাদের মধ্য থেকে ১৫০ জনকে বাংলাদেশি শনাক্ত করে ৮ জুন দেশে ফিরিয়ে আনে বিজিবি। এর পরের ধাপে ২৯ মে নিজেদের জলসীমা থেকে ৭২৭ জনকে উদ্ধার করে মিয়ানমারের নৌবাহিনী, যাদের রোহিঙ্গা ও বাঙালি পরিচয় দেয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম। এদিকে কক্সবাজারের টেকনাফে অভিযান চালিয়ে সাত মানব পাচারকারী দালালকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরা প্রত্যেকেই মানব পাচারের তালিকাভুক্ত। গতকাল ভোরে গোপন সংবাদে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাত মানব পাচারকারী দালালকে গ্রেফতার করা হয়। এরা হচ্ছে, টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া এলাকার জাফর আলম (২৭) ও নজির আহাম্মদ (৩৫), ডাঙ্গরপাড়া এলাকার শহিদুল ইসলাম (২৫) ও মো. ফরিদ (৫৫), ঘোলাপাড়া এলাকার জাফর আলম (৫২) ও বদি আলম (২৯) এবং দক্ষিণপাড়া এলাকার জহির আহাম্মদ (৬০)। তাদের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে আদালতে পাঠনো হবে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতাউর রহমান খোন্দকার।
অন্যদিকে অভিবাসীদের ভাগ করে নিতে বৈঠক করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টারত হাজার হাজার অভিবাসীর সংকট মোকাবিলায় গতকাল লুক্সেমবার্গে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
অভিবাসীদের ইউরোপের ২৮টি রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার বিষয়টিই বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠতে যাচ্ছে। দেশগুলো জানিয়েছে, অভিবাসী সংকটের ফলে ইতালি, গ্রিস ও মাল্টার সম্পদের ওপর বিশাল চাপ পড়েছে। আবার কোনো কোনো দেশ বলছে, অভিবাসন-প্রত্যাশীরা যেতে চায় না এমন দেশে কাউকে যেতে বাধ্য করা উচিত হবে না।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত আঠারো শ’র বেশি অভিবাসী ভূমধ্যসাগরে প্রাণ হারিয়েছেন। গত বছরের চেয়ে এ সংখ্যা ২০ গুণ বেশি। নিহতদের বেশির ভাগই সংঘাতপূর্ণ লিবিয়া ছেড়ে ছোট ছোট জীর্ণ নৌকায় করে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথে রওনা হয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে নৌবাহিনীর সদস্যরা এমন অনেক অভিবাসীকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করেছেন। ইতালি ও গ্রিসের উপকূলে এ বছর ইতিমধ্যে এক লাখের বেশি অভিবাসী সমুদ্রপথে গিয়ে পৌঁছেছেন। এসব অভিবাসীকে ভাগ করে নিয়ে তাদের বোঝা হালকা করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশকে জোরাজুরি করছে ইতালি ও গ্রিস।
মানব পাচারকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে : মানব পাচারকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, মানব পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ার কিছু মানুষ জড়িয়ে পড়ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে গতকাল মানব পাচার বন্ধে করণীয় শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ কথা বলেন। সংগঠনের সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য দেন সংগঠনের নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, রেজওয়ানা হাসান, ডা. হামিদা হোসেন, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিনিধি স্টিনা লুংডেল প্রমুখ। ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে বিপুলসংখ্যক অভিবাসী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন, কেউ কেউ কারারুদ্ধ হচ্ছেন। তিনি বলেন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে একটি নগ্ন নব্য দাস প্রথার আবির্ভাব ঘটেছে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, মালয়েশিয়ার একদল মানুষ এ অপকর্মে জড়িত। মানব পাচার, জিম্মিকরণ, জবরদস্তিমূলক কারারুদ্ধকরণ, এমনকি হত্যা তাদের অপকর্মের অংশ। গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্সের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৬ লাখ ৮০ হাজার ৯০০ জন আধুনিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। ইউএনএইচসিআরের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ২৫ হাজার ব্যক্তি অবৈধভাবে দেশত্যাগ করেছেন। স্টিনা লুংডেল বলেছেন, শুধু গ্রামের সাধারণ একজন দালাল কিংবা রিকশাওয়ালার মতো নিুপর্যায়ের লোককে গুলি করে মানব পাচার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, এ জন্য সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। স্টিনা লুংডেল বলেন, মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করছে। এ নির্যাতনের কারণে ভৌগোলিকভাবে কাছে হওয়ায়, ধর্মীয়ভাবে এক হওয়ায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরতা চলছে রাখাইনে, যেখানে ধর্ম, ভাষা ও জাতিগতভাবে এক না হওয়ার কারণে তাদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে। বৌদ্ধ মৌলবাদ ও উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সহ্য না করে রোহিঙ্গারা এ দেশে আসে। সরকার যতটা পেরেছে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এটি সমস্যার সমাধান নয়। সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, থাইল্যান্ডে মানব পাচারে জড়িত থাকার কারণে একজন জেনারেলকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা একজন কনস্টেবলকেও বরখাস্ত করতে পারি না। আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দেশে রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩২ হাজার। এর আগেও আমরা আটকেপড়া পাকিস্তানিদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু আমাদের অতিরিক্ত জনসংখ্যার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে পারে, কারণ তাদের প্রচুর জনবল চাহিদা রয়েছে। আর মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে কেবল দোষ দিলে চলবে না, শান্তিতে নোবেল পাওয়া অং সান সু চির ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক। রেজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত না থাকলে এত সহজে তারা যায় কীভাবে? আর বর্ডারে দায়িত্বরতরাই বা কী করে? যদি তারা জড়িত নাও থাকে তাহলে তারা ব্যর্থ। সে জন্য তাদের শাস্তি দেওয়া হোক। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাচার রোধে কী কাজ করছে তা স্পষ্ট করতে হবে।

সর্বশেষ খবর