সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

পাহাড়ি ঢলে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ

পাহাড়ি ঢলে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ

জলাবদ্ধতায় বিপর্যস্ত চট্টগ্রাম। হাঁটু সমান পানি দিয়েই চলতে হচ্ছে রাজপথে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নিুাঞ্চল তলিয়ে রয়েছে। কয়েক স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে। অনেক জায়গায় নৌ ও স্থল পথে চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
ফেনী : ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহুরী নদীর দুটি স্থানে ও কহুয়া নদীর একটি স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ফুলগাজী উপজেলার ১০টি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। পানিতে ভেসে গেছে প্রায় হাজার খানেক পুকুর ও মাছের ঘের। ঘর-বাড়ি ও দোকান পাটে পানি ঢুকে পড়ায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। ভেঙে গেছে বাঁধের কাছাকাছি থাকা কাঁচা ঘর-বাড়ি। তবে গতকাল রাতে পাওয়া খবর অনুযায়ী, ভারি বর্ষণ কমে যাওয়ায় ফেনী শহরের বিভিন্ন সড়ক থেকে পানি নামতে শুরু করেছে।
লালমনিরহাট : হাতীবান্ধা-বড়খাতা সড়কের ভাঙা অংশ দিয়ে ধেয়ে আসা পানি প্রবাহ উপজেলার চারটি ইউনিয়নের হাজার হাজার কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, গড্ডিমারী বাজারের অদূরের হাতীবান্ধা-বড়খাতা সড়কের ওই ভাঙা অংশ দিয়ে প্রচণ্ড বেগে পানি ঢুকছে। এতে করে রাস্তার পূর্ব দিকে গড্ডিমারী, সিংঙ্গীমারী, সিন্দিুর্ণা ও পাটিকাপাড়া ইউনিয়নের নিচু অংশের কয়েক হাজার হেক্টর জমি পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ওইসব জমিতে আমন ধানের চারা লাগাতে পারেননি কৃষকরা।
চাঁদপুর : মেঘনা ও পদ্মা নদীতে প্রচণ্ড স্রোত, ঢেউ ও আবহাওয়া পরিবর্তন হওয়ায় চাঁদপুর নৌবন্দরকে গতকাল ২ নম্বর নৌ বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এ কারণে নদী পথের সব নৌযান ও যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চাঁদপুর নৌবন্দরের দায়িত্ব থাকা কর্মকর্তা উপপরিচালক নদীবন্দর চাঁদপুর মোস্তাফিজুর রহমান।
চট্টগ্রাম : মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গতকালও চট্টগ্রামে ভারি বর্ষণ অব্যাহত ছিল। ফলে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে নগরী ও জেলার আরও কিছু নিুাঞ্চল। হাঁটু থেকে গলা পরিমাণ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে জনসাধারণকে। আবহাওয়া অফিসের পক্ষ থেকে সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৩ নম্বর ও নদীবন্দরগুলোকে ২ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর-বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছে এসে সাবধানে চলাচল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে একটানা প্রবল বর্ষণ ও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাস কার্যক্রম গতকাল একপ্রকার বন্ধ ছিল। বন্দরের বহির্নোঙরে খাদ্যপণ্য ও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালবাহী ১৫টি বড় জাহাজ পণ্য খালাসের অপেক্ষায় বসে আছে। বন্দর জেটিতে কন্টেইনারবাহী জাহাজে পণ্য উঠা-নামার কাজ চললেও কার্গো জাহাজে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া নগরীর মোহাম্মদ আলী রোডে ম্যানোলা কোম্পানির মালিকানাধীন একটি পাহাড় ধসে জেলা শিল্পকলা একাডেমির অফিস ও মহড়া কক্ষের দেওয়াল ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে।
কক্সবাজার : কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া রামু পেকুয়া ও সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এই ৪ উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম পাহাড়ি ঢল ও বন্যা পানিতে তলিয়ে আছে। চকরিয়া উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত মাতামুহুরী নদীর ৩টি পয়েন্ট যথাক্রমে সওদাগর ঘোনা, কন্যার কুম এবং পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত বিশাল বেড়িবাঁধ গতকাল দুপুরের দিকে ঢলের পানির তোড়ে ভেঙে যায়। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে প্রায় সহস াধিক বাড়িঘর ডুবে গেছে বলে জানিয়েছেন উপজেলার চেয়ারম্যান জাফর আলম। এদিকে কক্সবাজার টেকনাফ মহাসড়কের ৪টি পয়েন্ট দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় গতকাল দুপুর ১২টা থেকে এই সড়কের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিকল্প হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ রোড দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে।
চকরিয়া : চার দিনের টানা ভারি বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে চকরিয়া ও পেকুয়ার অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। দুই উপজেলার অভ্যন্তরীণ গ্রামীণ সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে যোগাযোগে বিপর্যয় ঘটেছে। মাতামুহুরী নদীর চিরিংগা ব্রিজ পয়েন্টে ঢলের পানি বিপদসীমানার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে মৎস্য ঘেরের মাছ ও তলিয়ে গেছে বীজতলা।
বান্দরবান : টানা চার দিনের ভারি বর্ষণে জেলা সদর ও লামা উপজেলায় ৫ শতাধিক বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। বান্দরবান-কেরানীহাট প্রধান সড়কের নিুাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় গতকাল থেকে বান্দরবানের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। অন্যদিকে বান্দরবান সদর ও লামা উপজেলায় পাহাড় ধসে শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৭ জন। থানছি, রুমা ও রোয়ংছড়ি উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বান্দরবান পৌর এলাকায় নিুাঞ্চল বরিশাল পাড়া, শেরেবাংলা নগর ও সাঙ্গু নদীর পাড়ে বসবাসরত পরিবারগুলো বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন।
খাগড়াছড়ি : প্রবল বর্ষণে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস ও ঝড়ো হাওয়ায় বৈদ্যুতিক খুঁটি বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে গত শনিবার রাত থেকে খাগড়াছড়ি গোটা জেলা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে। পৌর শহরের শাবলবন, মোহাম্মদপুর, সবুজবাগ, হরিনাথপাড়া ও কুমিলা টিলা এলাকায় পাহাড়ধসের সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় সহস াধিক পরিবার পাহাড় ধসের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
শরীয়তপুর : পদ্মা নদী উত্তাল থাকায় গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা হতে মাওয়া-মঙ্গলমাঝির ঘাট ও কাওরাকান্দি নৌপথের সবগুলো ঘাটে লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শরীয়তপুরের মঙ্গল মাঝির ঘাট, মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ও কাওড়াকান্দি ঘাটে কয়েক হাজার যাত্রী আটকা পড়েছেন। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সহকারী পরিচালক খাজা সাদিকুর রহমান বলেন, আবহাওয়া খারাপ থাকায় পদ্মা নদী বেশ উত্তাল। এ কারণে লঞ্চ, সিবোট ও ট্রলার চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। কাওড়াকান্দি ঘাট হতে ফেরি চলাচল করছে। কিছু যাত্রী ফেরিতে পারাপার করা হচ্ছে।
নওগাঁ : মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে নওগাঁর নিয়ামতপুরের নিুাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। চন্দননগর ইউপির কৃষ্টপুর, সন্তোষপাড়ার কিছু অংশ, ভাবিচা ইউপির কয়াশ, কালপুর, কর্ণপুর, চকদেওলিয়া, হাটোর, সিদাইন, জিনপুর, রাওতাড়ার কিছু অংশ গাবতলী, মালঞ্চি, চকসিতা, শ্রীমন্তপুর ইউপির হরিপুর, দর্গাপাড়া, বাহাদুরপুর ইউপির বাহাদুরপুর, রাধানগর এর নিুাঞ্চল বিশেষ করে শিব নদীর পশ্চিমপাড়ের হাজার হাজার হেক্টর জমি পানিতে ডুবে রয়েছে। এ ছাড়া চন্দননগর ইউপির কৃষ্টপুর ভাবিচা ইউপির কয়াশ, হাটোর, কালপুর, কর্ণপুর গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন।
মানিকগঞ্জ : বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে লঞ্চ পারাপার বন্ধ রয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে বিআইটিএর নির্দেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করা হয়। বিআইটিএর পরিচালক (আরিচা নদীবন্দর) এনামুল হক ভূইয়া জানান, লঞ্চ পারাপার বন্ধ থাকলেও যাত্রীদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। সব যাত্রী নির্বিঘ্নে ফেরি পারাপার হচ্ছেন।
নোয়াখালী : টানা ভারি বর্ষণে নোয়াখালী জেলার নয়টি উপজেলার গ্রামগঞ্জের ৭০-৮০ ভাগ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে রয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিদ্যুৎ সরবরাহের সব লাইন বন্ধ ছিল। এতে লাখ লাখ গ্রাহক অন্ধকারে পড়ে একটানা চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। এ দিকে বাতাস, ঝড়ো হাওয়া, ভারি বর্ষণ, বজ বৃষ্টি ও নিুচাপের প্রভাবে হাতিয়া উপজেলার নিঝুমদ্বীপ, নঙ্গলিয়া, নলেরচর, কেয়ারিংচর নলচিরা, সুখচর, তমরদ্দি, চরঈশ্বর, চরকিং, সোনাদিয়া ও হাতিয়া পৌরসভার উকিলপাড়া, চরলটিয়া, ওছখালীবাজারসহ ৫০টি গ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার কোথাও কোথাও ৪-৬ ফুট পানির নিচে রয়েছে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার পানিবন্দী মানুষ নিজ উদ্যোগে পানি নিষ্কাশনে ব্যস্ত রয়েছেন। এক সপ্তাহের টানা ভারি বর্ষণে বসতবাড়িসহ আশপাশ ডুবে গেছে। পানি অপসারণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ওই এলাকার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। ফলে স্থানীয়রা সেচ পাম্প দিয়ে পানি সড়ানোর চেষ্টা করছেন।
ঝালকাঠি : অব্যাহত বৃষ্টির ফলে কাঁঠালিয়া উপজেলার বিষখালী নদীর তীরবর্তী শৌলজালিয়া ইউনিয়নের রঘুয়ারদড়ি চর গ্রামের ফকির বাড়ি, শহীদুল ইসলাম ও ফজলুর রহমানের ইট ভাটার সামনের বেড়িবাঁধ ভাঙন দেখা দেওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন রঘুয়ারদড়ি চর শৌলজালিয়া গ্রামের মানুষ। উপজেলার রঘুয়ারচর গ্রামের ফকির বাড়ির কয়েকটি ঘরসহ শত শত একর ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে।

সর্বশেষ খবর