শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

কলহের রাজনীতি ফেনীতে

নিজাম হাজারীর কথাই শেষ কথা

ফেনী জেলায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী এমপির নির্দেশনা মতো একাট্টা হয়ে কাজ করছে। ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় হাজী রহিম উল্যাহ এমপি (ফেনী-৩, স্বতন্ত্র) মাঝে-মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও নিজাম হাজারীর অনুসারীদের (সোনাগাজীর স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ    নেতা কর্মীদের) বারবার ধাওয়া খেয়ে নিজ আসনেই অবস্থান নিতে পারছেন না। ঈদের দিনও রহিম উল্যাহকে ধাওয়া করা হয়েছে বলে জানা যায়। দীর্ঘ ২০ দিন ধরে রহিম উল্যাহর নির্বাচনী এলাকা দাগনভূঞা পানিতে তলিয়ে থাকলেও তিনি সেখানে যাননি। এ ব্যাপারে তিনি জানান, ত্রাণ বিতরণ করার চেষ্টা করেও তিনি দাগনভূঞার আওয়ামী লীগ নেতাদের অসহযোগিতার কারণে এলাকায় যেতে পারেননি। তিনি অভিযোগ করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ফেনী সার্কিট হাউসে যুবলীগ নেতা-কর্মীরা তাকে লাঞ্ছিত করেছেন। দাগনভূঞায় গেলেও লাঞ্ছিত হওয়ার আশঙ্কায় তিনি যাননি। তবে তিনি র‌্যাব ও পুলিশের সহযোগিতায় সোনাগাজীতে কিছু কিছু রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি পালন করেন। বাস্তবতা হলো ফেনীতে নিজাম হাজারীর ইচ্ছার বাইরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কারও কিছু করার ক্ষমতা নেই। তার কথাই এখানে শেষ কথা। স্বনামখ্যাত জয়নাল হাজারীর রাজনৈতিক পরাজয়ের পর অনেকটা ভেঙে পড়া জেলা আওয়ামী লীগকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার ও কেন্দ্রীয় নেতা আলাউদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী নাসিম নেপথ্যে থেকে নিজাম হাজারীকে দিয়ে শক্ত হাতে গড়ে তোলেন। এরই পরিণতিতে বেগম খালেদা জিয়ার নিজ জেলা বিএনপি অধ্যুষিত এ অঞ্চলটি হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগের দুর্গ। বিগত উপজেলা নির্বাচনে ফেনীর ছয়টি উপজেলার সবকটিতে বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। ফেনী পৌরসভায় জাতীয় পার্টির ১ হাজার ভোটও নেই, তা সত্ত্বেও মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীকে মনোনয়ন না দিয়ে জাতীয় পার্টির নেতা হাজী আলাউদ্দিনকে মহাজোটের প্রার্থী করে জয়ী করে আনেন নিজাম হাজারী। আওয়ামী লীগে প্রকাশ্যে কোন্দল না থাকলেও যোগদানকারীদের জেলা কমিটির শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করায় ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে কয়েক ব্যক্তিকে জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল পদে দেওয়ায় ত্যাগী নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। জেলার সাবেক কয়েক ছাত্রলীগ নেতাকে জেলা কমিটিতে রাখলে ‘নিখুঁত’ হতো বলে মনে করেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। ২০১২ সালের ২৬ ডিসেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি হলেও অনুমোদন পায়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ৩ বছরেও কেন অনুমোদন দেওয়া হয়নি সে ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রহমান বিকম জানান, সম্মেলনের দিনই সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও ৫ জন সহ-সভাপতিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাকিদের ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি হওয়ার পর ফেনীতে আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন ফেনীর একদার একক নিয়ন্ত্রক জয়নাল হাজারী। কালের বিবর্তনে বর্তমান যুগের ক্যাডাররা বেশ কয়েকবার তার উপস্থিতিতে তার বাড়িতে ভাঙচুর চালানোর পর তিনি ঢাকা থেকে ফেনী আসাই বন্ধ করে দেন। ঢাকা থেকে দৈনিক ‘হাজারিকা’ সম্পাদনা করে তিনি এখন সময় কাটাচ্ছেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনীর ৩টি আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নমিনেশন ক্রয় করেও তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হয়েছিলেন। নমিনেশন যাচাই-বাছাইয়ের দিন হেলিকপ্টারে করে আদালত পাড়ার বিপরীত পাশে পুলিশ লাইনে নামেন এবং পুলিশের গাড়ি করে জেলা প্রশাসনের মিলনায়তনে আসেন। কিন্তু যাওয়ার সময় তার পিছু নেন স্থানীয় ক্যাডাররা। অল্পের জন্য বেঁচে যান হামলা থেকে। এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জেলা পরিষদ প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এখন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের প্রতিটি কর্মসূচিতে প্রধান বা বিশেষ অতিথি থাকেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিম। সূত্র জানায়, পর্দার আড়ালে থেকে পুরো দলকে তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। জেলা ছাত্রলীগের চার বছর পর কাউন্সিলের মাধ্যমে এ বছর ১৪ মে নতুন কমিটি হয়। নতুন মুখ ও নিয়মিত ছাত্রদের নিয়ে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন প্রশংসা অর্জন করে। এ ছাড়া ফেনী কলেজ, সদর, পৌরসভাসহ সব উপজেলায় ছাত্রলীগ নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি করা হয়েছে। ছাত্রলীগের বর্তমান নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি বা অনৈতিক কোনো অভিযোগ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। জেলা যুবলীগের ১০ বছরের পুরনো আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে ২০১২ সালে নতুন আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। ৩ মাসের মধ্যে তারা সব ইউনিটের কমিটি করে জেলা কমিটি করার কথা থাকলেও ৩ বছরেও তা হয়নি। যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক সুশেন চন্দ্র শীল ও স্বপন মিয়াজি জানান, ফেনী পৌর যুবলীগের কমিটি ছাড়া তাদের সব ইউনিটের কমিটি হয়েছে। অক্টোবরের মধ্যেই সম্মেলনে জেলা যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হবে। জেলা মহিলা যুবলীগেরও এখানে একটি কমিটি রয়েছে। অন্যান্য সহযোগী সংগঠন এখানে সক্রিয়। তবে নতুন করে কমিটি হচ্ছে না। ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হক একরামকে স্ব-দলীয় প্রতিপক্ষ গুলি করে কুপিয়ে ও গাড়িসহ পুড়িয়ে হত্যা করায় ১৫টি বিদেশি অস্ত্রসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের ২৬ নেতা-কর্মী র‌্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর প্রতিবাদে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় জেলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় স্ব-দলীয় প্রতিপক্ষের হামলায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের চার নেতা-কর্মী নিহত হওয়ায় ও ১০/১২ জন বিভিন্ন সময় গুলিবিদ্ধ হওয়ায়, জনপ্রতিনিধিসহ দলীয় নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে টেন্ডারবাজি, বালুমহাল দখল, সরকারি জায়গা ও ব্যক্তি-মালিকানা জায়গা দখল, নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িয়ে যাওয়ায় দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তবে দলের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে নিজাম হাজারী বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ দেওয়া, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশে জেলার সর্বত্র বিচরণ করছেন প্রতিনিয়ত।

সর্বশেষ খবর