শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

আমার মেয়েটার না জানি কত কষ্ট হচ্ছে

আমার মেয়েটার না জানি কত কষ্ট হচ্ছে

ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন সুরাইয়া। ইনসেটে মা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

মা নাজমা বেগম তুলার মতো তুলতুলে দুটি পায়ে হাত রাখলেন। আলতো করে গালে আদর করলেন। ঘুম ভাঙল শিশু সুরাইয়ার। তারপর দুধ খাওয়ালেন। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সয়ে মেয়ের পাশে বসে থাকলেন। ঘণ্টাখানেক পর আর পারলেন না। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে ফিরে এলেন তিন তলায় নিজের কেবিনে। ছলছল চোখে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে বললেন, ‘আমার মেয়েটার না জানি কত কষ্ট হচ্ছে। আমি মা হয়ে গুলির যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। আর ও তো ছোট শিশু। পৃথিবীতে আসার আগেই আমার নিষ্পাপ বাচ্চাকে যারা কষ্ট দিল, তাদের বিচার চাই। ফাঁসি চাই।’ গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে এ দৃশ্য। মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ মাগুরার শিশু সুরাইয়া এখনো তার মায়ের কোলে ফিরতে পারেনি। বরং নাজমা বেগম তার মেয়ের কাছে যাচ্ছেন সময়মতো খাওয়ানোর জন্য। হুইল চেয়ারে চড়ে দুই ঘণ্টা পরপর তিন তলার ৪৮ নম্বর কেবিন থেকে দোতলার এনআইসিইউতে (নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) যেতে হচ্ছে। এভাবেই চলছে মা-মেয়ের ক্ষণিকের দেখাদেখি। চিকিৎসকরা বলছেন, মা-মেয়ের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। এখন তারা ভালো আছেন। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নবজাতকের খাওয়ার চাহিদা বাড়ছে। এ জন্য মাকে বারবার আসতে হচ্ছে। এতে মায়েরও কষ্ট হচ্ছে। আর এ কারণেই রবিবার শিশুটিকে তার মায়ের কেবিনে পাঠানোর চিন্তা করা হয়েছে। নাজমা বেগম বলেন, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে যত না কষ্ট পেয়েছি তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি পেটে গুলি লাগার কারণে। সিজারের ব্যথা কিছুটা কমলেও গুলি বের করতে পেটের যে অংশ কাটা হয়েছে সেখানে প্রচণ্ড ব্যথা। যন্ত্রণায় নড়াচড়া করতে পারছি না। ঘুমাতে পারছি না। জোরে কথা বলতে পারছি না। খেতেও কষ্ট হচ্ছে। তিনি জানান, সুরাইয়ার যে চোখে গুলির আঘাত লেগেছে সেটির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সিঁদুরের মতো টকটকে লাল হয়ে আছে চোখ। দীর্ঘদিন ধরে এনআইসিইউতে থাকার কারণে গায়ের রংও একটু কালচে দেখাচ্ছে। সুরাইয়ার চোখ সম্পূর্ণ ভালো করতে প্রয়োজন হলে তাকে সিঙ্গাপুর বা অন্য যে কোনো স্থানে চিকিৎসা করানোর জন্য দাবি জানাচ্ছি। গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য প্রফেসর ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা জানান, মা-মেয়ে দুজনই বেশ ভালো আছেন। সকালে বোর্ডের আরেক সদস্য ও তার স্ত্রী ডা. কানিজ হাসিনা শিউলি শিশুটিকে দেখে এসেছেন। সুরাইয়ার চোখের ব্যাপারে তিনি বলেন, চোখের বিষয় যিনি দেখছেন তার কাছ থেকে আমরা এখনো শিশুটিকে বিদেশে চিকিৎসা করানোর মতো কোনো পরামর্শ পাইনি। আমরা মনে করি, দেশেই চোখের চিকিৎসা করানো সম্ভব। এদিকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় মূল হোতারা এখনো গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুরাইয়ার বাবা-মা। তারা বলেন, সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু মূল অপরাধীরা শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই মনের শান্তি পাচ্ছি না। নাজমা বেগম বলেন, আমি কেবল একটা কথাই ভুলতে পারছি না। ঘরে ঢুকে আমাকে যখন গুলি করতে গেল, বারবার করে বলছিলাম, আমাকে গুলি করিস না, আমার পেটে বাচ্চা। কিন্তু কেউ শুনল না আমার কথা। আমার বাচ্চাটাকে গুলি করল, কষ্ট দিল। শিশুর বাবা বাচ্চু ভুইয়া বলেন, ঘটনাটি চরম দুর্ভাগ্যের এবং কষ্টের। কিন্তু তারপরও বলব, এ ঘটনার মাধ্যমে আমার জীবনের বড় অভিজ্ঞতা হয়েছে। দেশের মানুষের মানবিকতার পরিচয় পেয়েছি। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে গুলি করতে দেখে একেবারেই ভেঙে পড়েছিলাম। ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, আমি দুটি মানুষকে চিরতরে হারিয়ে ফেলছি। মনে হচ্ছিল, দুজনের কাউকেই আমি আর বাঁচাতে পারব না। ফিরে পাব না। কেবল আশপাশের মানুষ তথা সারা দেশের মানুষ সাহস দিয়েছে বলেই আমি ভরসা পেয়েছি। আর সে কারণেই সুরাইয়াকে ডাক্তার বানাতে চাই। আজ সবার সাহায্য-সহযোগিতা এবং চিকিৎসা সেবায় যেভাবে সে বেঁচে গেছে, আমি চাই সেভাবেই সে একদিন মানুষের সেবা করার জন্য বড় হোক।

সর্বশেষ খবর