শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঝুলে আছে যৌন নিপীড়নের আলোচিত মামলা

ঝুলে আছে যৌন নিপীড়নের আলোচিত মামলা

দীর্ঘ সময় পার হলেও দেশের আলোচিত যৌন নিপীড়নের মামলাগুলোর বিচার ঝুলে আছে। এর মধ্যে বেশ কিছু মামলা আছে, যেখানে ভুক্তভোগীকে ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ মামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা পলাতক আছে, কোনো ক্ষেত্রে আসামিদের করা আপিলের কারণে বিচার ঝুলে আছে, আবার কোনো মামলার আসামিদেরই চিহ্নিত করা যায়নি। আলোচিত এ মামলা নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ উভয় দিক থেকে চাপ থাকা সত্ত্বেও বিচার শেষ না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট মহল হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, দেশে আইনের সুশাসন নেই। আর আলোচিত মামলাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকায় মানুষের মধ্যে বিচারপ্রাপ্তি নিয়ে এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে পাঁচ হাজার মামলা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতে বিচার হয়েছে মাত্র ৮২১টি মামলার। আর ধর্ষকদের মধ্যে শাস্তি হয়েছে মাত্র শতাধিকের। এ ছাড়া দেশের বিদ্যমান আইনে ধর্ষণ মামলা সাধারণত জামিন অযোগ্য। কিন্তু প্রায়ই দেখা যাচ্ছে ধর্ষকরা গ্রেফতারের কিছুদিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে আসছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনে বলা হলেও তা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চলে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ২০(৩) ধারায় বলা হয়েছে, বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে মামলাপ্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু এ আইন মেনে কাজ করছেন না নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্টরা। এতে মামলায় পড়ে হয়রানি ও নিঃস্ব হতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মামলার বিচার যথাসময়ে শেষ হলেই দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এমনকি অপরাধীদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার করলে এক ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। সমাজে অপরাধ কমে আসবে। এ জন্য আমাদের বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে। পুলিশকেও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। অবস্থা এমন যে, সমাজের বিত্তশালী কিংবা গরিব কেউই যথাসময়ে বিচার পাচ্ছেন না। এ জন্য কিছু ক্ষেত্রে বিচারকাজ বিলম্বিত করছেন প্রভাবশালীরাই।’
শাজনীন হত্যা মামলা : ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান শিল্পপতি লতিফুর রহমানের মেয়ে স্কলাস্টিকা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী শাজনীন তাসনিম রহমান (১৫)। ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল রাজধানীর গুলশানের বাসায় ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় শাজনীনকে। আলোচিত এ মামলার আসামিরা হলেন বাড়ির সংস্কার কাজের দায়িত্ব পালনকারী ঠিকাদার সৈয়দ সাজ্জাদ মইনুদ্দিন হাসান, গৃহকর্মী শহীদুল ইসলাম শহীদ, হাসানের সহকারী বাদল, গৃহপরিচারিকা মিনু ও পারভীন এবং কাঠমিস্ত্রি শনিরাম মণ্ডল। এই ছয়জনের বিচার শুরু হয় ২০০০ সালের ৯ জুলাই এবং শেষ হয় ২০০৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এক রায়ে ছয় আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন। এরপর আসামিদের পক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়। ২০০৬ সালের ১০ জুলাই উচ্চ আদালতের একটি মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিতকরণ বেঞ্চ এক রায়ে নিু আদালতে ফাঁসির আদেশ পাওয়া হাসান, শহীদ, বাদল, মিনু ও পারভীনসহ পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে রায় দেন। তবে শনিরাম বেকসুর খালাস হন। উচ্চ আদালতের রায়ের তিন বছর পর ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল দণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামির লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। এই আসামিরা হচ্ছেন হাসান, বাদল, মিনু ও পারভীন। আরেক আসামি লিভ টু আপিলের আবেদন না করায় অনুমতি পাননি। মামলাটি এখন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। উল্লেখ্য, শাজনীন হত্যা মামলায় তার বাবা লতিফুর রহমান বাদী হয়ে গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে থানা হয়ে মামলার তদন্তভার যায় সিআইডি পুলিশের কাছে। সিইআইডির তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি মুজিবুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার আলামত পাওয়ায় নিজে বাদী হয়ে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমন আইনে আসামিদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে লতিফুর রহমানের মামলার চার্জশিট হয় ২০০০ সালের ২৮ মে। এরপর ধর্ষণ মামলায় বিচার হয়। অন্য মামলাটি উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত থাকে।
ধর্ষক পরিমলের বিচার : আলোচিত নারী নিপীড়নের মামলাগুলোর মধ্যে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষণের মামলা একটি। এ মামলার অভিযুক্ত আসামি শিক্ষক পরিমলের বিচার এখনো শুরু হয়নি। ২০১১ সালের ২৮ মে নির্যাতিত ছাত্রী সেই স্কুলের শিক্ষক পরিমলের বাসায় প্রাইভেট টিউশনি পড়তে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। এরপর ওই ছাত্রীর অভিভাবকদের করা এ-সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১১ সালের ৬ জুলাই ঢাকার কেরানীগঞ্জের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে পরিমলকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ তদন্ত করে চার্জশিট দেয়। কিন্তু চার বছর পরও সে মামলার বিচার শুরু হয়নি।
গারো তরুণী ধর্ষণ : রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় চলন্ত মাইক্রোবাসে গারো তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার আসামিদের সাজা হয়নি। র‌্যাব বলছে দ্রুত সময়ের মধ্যে চার্জশিট দেবে। এরই মধ্যে মামলার সব আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এ মামলায় গ্রেফতার করা হয় দুজনকে। ২১ মে একটি বেসরকারি প্রতষ্ঠানের গাড়িচালক আল আশরাফুল তুষার ও তার সহযোগী লাভলু মাইক্রোবাসে সেই তরুণীকে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করে। তারা র‌্যাবের কাছে ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করেছে।
গুলশানের জোড়া খুন : রাজধানীর গুলশানের কালাচাঁদপুরের নার্সারি ব্যবসায়ী সাদিকুর রহমান ও তার স্ত্রী রোমানা নার্গিস হত্যা মামলায় মো. রুবেল ও মিথুন চন্দ নামে দুজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং আলতাফ হোসেন আলতু নামের অপর আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এই হত্যাকাণ্ডের আরেক সহযোগী মহিউদ্দিন আজাদ রাব্বীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মূল আসামি রাব্বী ও মিথুন পলাতক থাকায় তাদের অনুপস্থিতিতে এ রায় হয়। ২০১০ সালের ২৪ মার্চ সাদেকুর রহমানের বাসায় ঢুকে তাকে এবং তার স্ত্রী রোমানা নার্গিসকে গুলি করে হত্যা করে রুবেল ও তার সহযোগী মিথুন। সাদেকুর রহমানের দশম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে ইতিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় রুবেল।
বর্ষবরণ, গ্রেফতার নেই : ঘটনার পর চার মাস পার হলেও এখনো চলতি বছরের বাংলা বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী-লাঞ্ছনার ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের একজনকেও ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি ঘটনার পর এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত পর্যন্ত করতে পারেনি পুলিশ। অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পুলিশ যে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছিল, এতেও সাড়া মেলেনি। ফলে অপরাধীদের ধরতে পুলিশের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই বর্বরোচিত ঘটনার তদন্ত এখন থমকে আছে। যদিও নারীদের ওপর করা যৌন হয়রানির দৃশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে স্থাপিত পুলিশের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে কিন্তু এর পরও কোনো অদৃশ্য কারণে অপরাধীদের ধরা যাচ্ছে না। এ ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার (ডিএমপি) মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছিলেন, বর্ষবরণের কোনো কিছুই পুলিশের নজরদারির বাইরে ছিল না। সেখানে যা ঘটেছে এর সবই পুলিশের ১৩১টি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে। সে সময় এ ঘটনা তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মোহাম্মদ ইব্রাহিম ফাতেমিকে সভাপতি করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলাও করা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু সে মামলারও কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা এ মামলায় আদৌ কাউকে শনাক্ত করা যাবে কি না এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

সর্বশেষ খবর