শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

ইতিহাসজুড়ে ধানমন্ডি ৩২

ইতিহাসজুড়ে ধানমন্ডি ৩২

একটি বাড়ি ঘিরে যে কত ইতিহাস থাকতে পারে তা অষ্টম শ্রেণির নাবিল জানতে পারল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ পরিদর্শন করে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় মামার সঙ্গে বেড়াতে এসে চলতি মাসের শুরুতেই নাবিল ঘুরে এসেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন তথা স্মৃতি জাদুঘরটি।
ইতিহাসসমৃদ্ধ এ বাড়ি ঘুরে নাবিল বেশ অবাক হয়েছিল। তার ধারণা ছিল দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির বাসভবন হবে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। কিন্তু সাদামাটা তিন তলা ভবন ও এ ভবনের বিভিন্ন আসবাবপত্র ছিল অত্যন্ত সাধারণ মানের। তবে দেয়ালে থাকা বুলেটের চিহ্ন দেখে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ওপর চালানো বর্বর নিষ্ঠুরতায় কষ্টে ভরে যায় কিশোর নাবিলের হৃদয়। সে জানায়, আবার আসবে এই জাদুঘরে। বন্ধুদের কাছে গিয়ে তাদেরও এ ইতিহাসসমৃদ্ধ স্থানটি ঘুরে যাওয়ার কথা বলবে। ঢাকায় ধানমন্ডির সড়ক নম্বর-৩২, বাড়ি নম্বর-৬৭৭ আর নতুন ঠিকানা অনুযায়ী ধানমন্ডির সড়ক নম্বর ১১ আর বাড়ি নম্বর ১০। এটিই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন। সাদা রঙের ভবনটিকে বঙ্গবন্ধু ভবনও বলা হয়। এখন জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতি বহনকারী একটি বাড়ি। বাড়িটির মূল কাঠামোর কোনো পরিবর্তন না করেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার্য বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে সাজানো হয়েছে জাদুঘর। আছে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র। বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে জানতে হলে দেশের সব নাগরিককে একবারের জন্য হলেও এখানে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ও সেই সময়ের সংবাদপত্র পড়ে জানা যায়, ইতিহাসঘেরা এ বাড়িটি ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত ঘাতকরা এবং পরবর্তী সময়ে সামরিক কর্তৃপক্ষ দখল করে রাখে। পরে ১৯৮১ সালেই বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বাড়িটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালের ১১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠনের পর বাড়িটিকে ট্রাস্টের অধীনে দেওয়া হয়। ট্রাস্টের উদ্যোগে বাড়িটিকে জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে এ বাড়িটিতে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ’৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ’৭১ সালের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন- এসব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা করা, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সবই করেছেন এই ৩২ নম্বর বাড়িতে। ’৭১-এর উত্তাল দিনগুলোয় দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও জাতির জনকের সঙ্গে দেখা করার জন্য এখানে ভিড় করেছিলেন। এ ছাড়া ৭ মার্চের সেই বিখ্যাত ভাষণের রূপরেখাও এ বাড়িতেই তৈরি করেছিলেন শেখ মুজিব। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে এ বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু তার কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। এরপর তিনি যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তখন এ ভবনেই ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫- সপরিবারে তাকে হত্যা করা হয়।
সরেজমিন এ ইতিহাসসমৃদ্ধ বাড়ি ও স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখা যায়, তিন তলা বাড়ির ভবনে ঢুকতে প্রথমেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বলা যায়, এক তলার প্রথম কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধু ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তোলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছবির মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এ তলায় আরও আছে পরিবারের নিহত অন্য সদস্যদের তৈলচিত্র। দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ। ১৫ আগস্ট ভোরে বেগম মুজিব, জামাল, কামাল, রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূর রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানে পড়েছিল। আর এ ঘরের সামনে করিডর থেকে নিচে যাওয়ার জন্য যে সিঁড়ি সেখানেই ঘাতকদের গুলিতে মারা যান বঙ্গবন্ধু। এখনো গুলির স্পষ্ট চিহ্ন সেখানে রয়ে গেছে। সিঁড়িটি দড়ি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া।
বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে তার বিছানার পাশেই ছোট টেবিলে সাজানো আছে তার হাতে থাকা পাইপটি। তামাকের কৌটা। এ কক্ষে অন্যান্য আসবাবের মধ্যে আরও আছে টেলিফোন সেট, রেডিও। কিছু রক্তমাখা পোশাক। সামনের খাবার ঘরের পাশেই আছে শিশু রাসেলের ব্যবহার করা বাইসাইকেল। উল্টো দিকে শেখ জামালের কক্ষে দেখা যায় তার সামরিক পোশাক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার কক্ষও একই তলায়। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষ। এ কক্ষে তার বিভিন্ন সংগীতযন্ত্র সাজিয়ে রাখা আছে। বাড়ির রান্নাঘরের হাঁড়িগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজানো। কিন্তু এ হাঁড়িতে আর কখনো রান্না হবে না।
এ ভবনের মোট নয়টি কক্ষে বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে আরও আছে বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বৌভাতের সবুজ বেনারসি শাড়ি, রোজী জামালের লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুড়ি, চুলের কাঁটা, শিশুপুত্র রাসেলের রক্তমাখা জামা, বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, লুঙ্গি, ডায়েরি ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবহার্য আসবাবের মধ্যে আরও আছে খাবার টেবিল, টেবিলের ওপর থালা, বাটি। আছে রেকসিনের সোফা। খাওয়ার পর এ সোফায় বসে বিশ্রাম নিতেন বঙ্গবন্ধু। বাড়ির দেয়াল, দরজায় বিভিন্ন জায়গায় ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বীভৎসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধুকে পাক হানাদারবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার করে। আর এ বাড়ি থেকেই তিনি দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা।
বাড়ির পেছনেই জাদুঘরের সম্প্রসারিত নতুন ভবন। এর নাম ‘শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুন’ গ্যালারি। বঙ্গবন্ধুর বাবা-মায়ের নামকরণে রাখা হয়েছে নতুন ভবনের নাম। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট এ অংশটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। ছয় তলা ভবনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র রয়েছে আর পঞ্চম তলায় পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র।
জাদুঘরের প্রতিটি জিনিসের বর্ণনা লেখা রয়েছে। দর্শনার্থী সেই লেখা পড়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের কথা নিজেদের স্মৃতিতে স্থান দিচ্ছেন। দর্শনার্থীদের জন্য সপ্তাহে মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বুধবার সাপ্তাহিক ছুটি। এ ছাড়া সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও জাদুঘর বন্ধ থাকে।

সর্বশেষ খবর