শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

নতুন হিসাব-নিকাশে ইসলামী দলগুলো

ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইস্যুতে আন্দোলনকারী ইসলামপন্থি দলগুলো মাঠে নামার জন্য নতুন করে হিসাব-নিকাশ করছে। ঈদুল ফিতরের আগে দলগুলো ঘোষণা দিয়েছিল ঈদ উৎসবের পর ইসলামের বিরুদ্ধে বক্তব্যদানকারী লতিফ সিদ্দিকীসহ নানান ইস্যুতে মাঠে নামবে তারা। এখন বলছে, সরকারবিরোধী বড় দলগুলো মাঠে সক্রিয় হলে, তাদের মাঠে নামার পরিবেশ সৃষ্টি হলে পরিস্থিতি বুঝে তারা মাঠে নামবে। সে সুযোগ হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেদের সংগঠন শক্তিশালীর কাজে ব্যস্ত থাকবে। পাশাপাশি প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে অঘোষিত সুসম্পর্ক ও রাজনৈতিক ময়দানে নমনীয়তা রক্ষা করে চলবে। আপাতত একা একা আন্দোলন করে নতুন করে হামলার শিকার হবে না।
দলগুলোর নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে সংবিধানের মূলনীতি থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের কথা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আদালত নির্দেশ দিয়েছেন বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা যাবে না। নারীনীতিতে কোরআনবিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব ইস্যুতে ইসলামী দলগুলো এক মঞ্চে এসে আন্দোলন করতে পারেনি। পৃথকভাবে আন্দোলন করে হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত তাদের সংগঠন। বড় দল মাঠে নামলে তারাও তাদের ইস্যুতে মাঠে নামবে।
জামায়াতে ইসলামী : পাঁচ বছর ধরে একা একা আন্দোলন করে জামায়াত আশানুরূপ ফল না পেয়ে হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত হয়ে এখন কৌশল পরিবর্তন করেছে। সরকার পরিবর্তনের লক্ষণ না দেখে এ অবস্থায় দলকে এবং দলের শীর্ষ নেতাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এমনকি স্বাভাবিক জীবনযাপনের স্বার্থে তৃণমূলে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়াই ভালো মনে করছে। এ জন্য ইতিমধ্যে তৃণমূলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। তারা বলছেন, বিএনপি মাঠে শক্ত অবস্থানে না আসা পর্যন্ত কৌশলী অবস্থানে থাকবেন তারা। তবে জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর দায়িত্বশীল নেতা আবদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, জামায়াত মাঠে আছে, থাকবে। আমরা সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করছি। ২০-দলীয় জোট থেকে আন্দোলনের ঘোষণা এলে আমরা মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ব। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ : প্রধান দুই জোটের বাইরে অন্যতম শক্তিশালী দল মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আহমদ আবদুল কাইয়ূম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, একটি কর্মসূচি দিলে পুলিশের অনুমতির জন্য দৌরাতে দৌরাতে জুতা ক্ষয় হয়ে যায়। তার পরও অনুমতি পাওয়া যায় না। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ধর্মীয় ইস্যুগুলো যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে। আসলে ধর্মীয় এসব ইস্যুতে আন্দোলন স্তিমিত হয়নি।  বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন : অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর তার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। হাফেজ্জী হুজুর প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী কামরাঙ্গীরচর জামিয়া নুরিয়া মাদ্রাসা, মসজিদ কমপ্লেক্স ও দলীয় অফিসের দোকানের ভাড়া মাসিক প্রায় ১০ লাখ টাকা কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এ নিয়ে এ সংকট। দলের গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী খেলাফত আন্দোলনের দায়িত্বে যারা থাকবেন তারাই মাদ্রাসারও দায়িত্বে থাকবেন। জানা যায়, ইতিমধ্যে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ও হাবীবুল্লাহ মিয়াজীর নেতৃত্বাধীন ‘খেলাফতে আহমদিয়া’ আতাউল্লাহ ও জাফরুল্লাহ খানের নেতৃত্বাধীন ‘খেলাফতে জাফরিয়া’ আবার আবদুল মালেক চৌধুরী ও ফিরোজ আশরাফীর নেতৃত্বাধীন ‘খেলাফতে মালেকিয়া’র পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছেন স্ব স্ব গ্রুপের সমর্থকরা। তবে প্রতিটি সংগঠনের নেতাই নিজেদের মূল বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন বলে দাবি করছেন এবং মাদ্রাসা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। জানতে চাইলে খেলাফত আন্দোলনের আমিরে শরিয়তের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা কাজী আজিজুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসার মাসিক সাড়ে ৭ লাখ টাকার নিয়ন্ত্রণ কে করবেন, এ নিয়ে হাফেজ্জী হুজুরের ছেলেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। আমিরের ছেলে হাবীবুল্লাহ মিয়াজী মাদ্রাসার অর্থ নিয়ে ঝামেলা বাধাচ্ছেন। তিনি সংযত না হলে সংগঠন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস : দুই জোটের বাইরে আরেকটি অন্যতম শক্তিশালী ধর্মীয় দল মরহুম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। সংগঠনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আজিজুল হক হেলাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আমরা আন্দোলনের মধ্যেই আছি। সভা-সমাবেশের জন্য প্রশাসনের অনুমতি পাই না। তরীকত ফেডারেশন : সংগঠনটি ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক দল। একমাত্র ইসলামী সংগঠন যারা নৌকা প্রতীকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য আইনি এবং রাজপথে লড়াই করে যাচ্ছে সংগঠনটি। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে তরীকতের দায়ের করা মামলায়। দলটির মহাসচিব এম এ আউয়াল বলেন, জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী দল। জামায়াত নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। খেলাফত মজলিস : সংগঠনটির কার্যক্রম চলে ২০-দলীয় জোটের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। দলের আন্দোলন প্রস্তুতির কথা জানতে চাইলে খেলাফত মজলিসের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক বলেন, দেশে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। কোনো অপরাধ ছাড়াই নেতা-কর্মীদের ধরে হত্যা মামলায় পর্যন্ত জড়ানো হচ্ছে। তাই রাজপথে কেউ নামতে সাহস পাচ্ছে না। ইসলামী ঐক্যজোট : বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোট একাংশের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, প্রায় সব দল নিজ নিজ সাংগঠনিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। এ ছাড়া সরকারবিরোধী দলগুলোকে রাজপথে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় এসব দল অনেকটা চুপচাপ থেকে সীমিত পরিসরে কাজ করছে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম : ২০-দলীয় জোটের এ শরিক দলটির অবস্থাও একই। এ বিষয়ে সংগঠনটির প্রচার সম্পাদক মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমান বলেন, বিএনপির উচিত ২০-দলীয় জোটের শরিক ইসলামী ছোট দলগুলোকে আস্থায় আনা। এ দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সমন্বয় না থাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। হেফাজতে ইসলাম : নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলোর বাইরে শক্তিশালী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটির প্রধান আল্লামা শাহ আহমদ শফীর কার্যক্রমও এখন চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় মাদ্রাসায় সীমাবদ্ধ। রাজধানীতে এখন আর নতুন করে কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারছে না তারা। লালবাগ মাদ্রাসায় মাঝেমধ্যে তাদের কিছুটা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়াও জাকের পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, ওলামা-মাশায়েখ তৌহিদী জনতা সংহতি পরিষদ, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিক ইসলামী ঐক্যজোট ও ইউনাইটেড ইসলামী পার্টিসহ বেশকিছু ইসলামী সংগঠন সীমিত পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত।

সর্বশেষ খবর