বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নবসাজে ছিটমহল

প্রধানমন্ত্রী আসছেন আজ, ভূমি জরিপ শুরু

রফিকুল ইসলাম রনি, সাইফুল ইসলাম তুহিন ও আমিনুল ইসলাম, দাশিয়ারছড়া (কুড়িগ্রাম) থেকে

নবসাজে ছিটমহল

৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবন শেষে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর জীবনে এসেছে নতুন দিন। ১৯৪৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত (৬৮ বছরে) কোনো সরকার বা রাষ্ট্র প্রধান পা মাড়াননি দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে। আজ সেই বিলুপ্ত ছিটমহলে আসছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মতবিনিময় করবেন ছিটমহলবাসীদের সঙ্গে। তার কল্যাণে আজ সেই বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর ঘরে ঘরে জ্বলবে আলো, স্থাপন করা হবে তিনটি বিদ্যালয় ও তিনটি হেলথ কমিউনিটি সেন্টার। সেই সঙ্গে শুরু হবে বিলুপ্ত ১১১ ছিটমহলে ভূমির মালিকানা বণ্টনের  কার্যক্রম। এ ভূমি জরিপের মাধ্যমেই সাবেক ছিটমহলবাসীর আতঙ্ক সাদা কাগজের দলিল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই ঘরে ঘরে আজ বইছে আনন্দের বন্যা।

প্রধানমন্ত্রীর দাশিয়ারছড়ায় আগমনের কথা শুনে বিলুপ্ত দাশিয়ারছড়া ছিটমহলের সাবেক গ্রামপঞ্চায়েত ৮৫ বছরের বৃদ্ধ শাহের আলী বললেন, বাপের (বাবার) হাতোত (হাতে) চুক্তি, বেটির (মেয়ের) হাতে মুক্তি বাহে। শ্যাখের বেটি (শেখের মেয়ে) হাসিনা হামার (আমার) মাও (মা) বাহে। তিনি হামার (আমাদের) জননী। না হইলে (হলে) এ্যাতদিন (এতদিন) কায়ো (কেউ) হামাকগুলাক (আমাদের) দেউখপার (দেখার) আসিল না (এলো না)। হামার (আমাদের) মাও (মা) ঠিকে (সত্যি) হামার কাছোত আইসপার নাগছে, ছওয়াগুলাক (সন্তানদের) দেইখপার (দেখার) জন্যে। কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অনার্সের রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. রবিউল ইসলাম রবি জানান, আমি আমার ঠিকানা গোপন করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমার আনন্দের শেষ নেই। আমি গর্বিত। তার কাছে দাবি জানাই, তিনি দাশিয়ারছড়ায় এলে আমরা যারা ছিটমহলের ছাত্র রয়েছি তাদের যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাভিত্তিক ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দেন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে চাকরিপ্রাপ্তিতেও যেন কোটা সংরক্ষণ করা হয়। এমন একজন দুজন নয়, দাশিয়ারছড়ার হাজার হাজার মানুষের মাঝে বাঁধভাঙা উচ্ছ¡াস আর আনন্দের হিলে­াল। ১৯৬৯ সালে ও ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু কুড়িগ্রাম জেলা সফর করলেও মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ছিটমহলে যেতে পারেননি। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনবার কুড়িগ্রাম জেলা সফর করেন। কিন্তু আজই প্রথম ৬৮ বছরে কোনো সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি প্রথম পা রাখবেন বিলুপ্ত দাশিয়ারছড়া ছিটমহল এলাকায়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রী ও দলীয় এমপি ছাড়াও তার সফরসঙ্গী হবেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিক, জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় দাশিয়ারছড়ার কালিরহাট বাজারের সুধী সমাবেশে যোগ দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে ৬৮ বছরের নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত এলাকায় চলছে উন্নয়নের জোয়ার। ফুলবাড়ী থানা সদর থেকে কালিরহাট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তায় ইতিমধ্যে ইট বিছানোর কাজ শেষ হয়েছে। এ সড়কপথেই ফুলবাড়ী থেকে প্রস্তাবিত মুজিব-ইন্দিরা ইউনিয়নে (সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহল দাসেরছড়া) প্রবেশ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দাশিয়ারছড়ায় ৬৪৩ পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ উদ্বোধন করবেন তিনি। এ ছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রতিটি পরিবারে (১ হাজার ৯০৬টি) বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে।

তোরণ-ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে কুড়িগ্রাম : প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে গোটা জেলার মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। কুড়িগ্রাম-রংপুর, কুড়িগ্রাম-চিলমারী, কুড়িগ্রাম-নাগেশ্বরী ও নাগেশ্বরী-ফুলবাড়ী সড়কে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে শত শত তোরণ স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ব্যক্তিবিশেষ স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে এ তোরণগুলো নির্মাণ করেছেন। ফেস্টুন-প্লাকার্ড-ব্যানার-পোস্টারে গোটা শহরকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। জনসভাস্থল সরকারি কলেজ মাঠে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকাসদৃশ বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। শহর ও লোকালয়ে চলছে মাইকিং ও মিছিল।

আজ থেকে শুরু হচ্ছে ভূমি জরিপের কাজ : আজ থেকে শুরু হচ্ছে ভূমি জরিপের কাজ। পুরনো নথিপত্র বিশ্লেষণ এবং দখলের ভিত্তিতেই পরিচালিত হবে এ কার্যক্রম। ভূমি জরিপ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে আহয়ক করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে জরিপ কার্যক্রম সম্পন্নের জন্য উপজেলার কানুনগোকে আহয়ক করে সাত সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির সদস্যরা ছিটমহলের মাঠ পর্যায়ে গিয়ে ভূমি জরিপের কাজ সম্পন্ন করবেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম স্বাক্ষরিত এক চিঠির আলোকে এসব কমিটি করা হয়েছে। আগামী ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৩০ দিন ভূমি জরিপের এ কার্যক্রম চলবে। বিলুপ্ত ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির পঞ্চগড়-নীলফামারী জেলার আহয়ক মফিজার রহমান জানান, সরকারি কর্মকর্তারা যাতে কোনো মানুষের জমি নিয়ে ছিনিমিনি না খেলেন এটা ছিটমহলবাসীর একমাত্র আবদার। কেউ যেন গায়ের জোরে অন্যের জমি দখল করতে না পারে সেদিকে নাগরিকদের খেয়াল রাখতে হবে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর