বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চিকিৎসা দরকার বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলের

রাহাত খান, বরিশাল

চিকিৎসা দরকার বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলের

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রবীন্দ্রনগর গ্রামের বাদশা হাওলাদার সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বোন আমিরুন্নেছা এবং ভাগ্নি জান্নাতুনকে উন্নত চিকিৎসার আশায় বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু মেডিকেলের অপরিচ্ছন্ন নোংরা আর শোরগোলযুক্ত মহিলা সার্জারি ওয়ার্ডে প্রায় এক মাস থাকা-খাওয়া এবং প্রতিদিন একবার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ভিজিট ছাড়া কিছুই জোটেনি তাদের কপালে। চিকিৎসকের পরামর্শে তাদের চিকিৎসার যাবতীয় ওষুধ এবং প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালের বাইরে থেকে করাতে হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোগীদের জন্য সরকারিভাবে এই হাসপাতালে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার আধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হলেও রোগীদের রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় বাইরে থেকে। ‘ডিজিটাল এক্সরে মেশিন নেই’ অজুহাতে হাসপাতালে আগত রোগীদের ডিজিটাল এক্সরে করাতে বাইরে ব্যক্তি মালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। রোগীরা অভিযোগ করেছেন, এক্সরে এবং প্যাথলজি বিভাগের টেকনিশিয়ান ও বহির্বিভাগের ডাক্তাররা হাসপাতালের সামনের ৫টি ডিজিটাল এক্সরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। টেকনিশিয়ানদের ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায় এ হাসপাতালে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন কেনা হয় না। হাসপাতালের আন্তঃ ও বহির্বিভাগের রোগী, তাদের স্বজন এবং চিকিৎসক, নার্স কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম-দুর্নীতি আর দলবাজি গ্রাস করে আছে দক্ষিণাঞ্চলের আধুনিক চিকিৎসার ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিত শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ১৯৬৮ সালে বিশাল এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ৫ তলা বিশিষ্ট ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালের ২৭টি আন্তঃ ওয়ার্ডে গড়ে দৈনিক রোগী ভর্তি থাকেন প্রায় ১২০০। এ ছাড়া বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন আরও অন্তত ১ হাজার রোগী। অসুস্থ একজন রোগীকে শেরেবাংলা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে ১১ টাকার টিকিট কাটতে হয়। টিকিট দেখেই রোগীকে ‘ওয়ার্ডে ভর্তি’ লিখে দেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক। এরপর ভর্তি টিকিট কিনতে হয় আরও ১৫ টাকায়। মোট ২৬ টাকায় একজন রোগীকে ওয়ার্ডে ভর্তির কথা থাকলেও ‘ভাঙতি নেই’ অজুহাতে গ্রামের রোগীদের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৫০ টাকা নেওয়া হয়। এখান থেকে একজন রোগীকে ট্রলিতে করে ওয়ার্ডে পাঠাতে হলে সংশ্লিষ্টদের দিতে হয় বখশিশ নামের উৎকোচ। না দিলে রোগীকে কোলে-পিঠে করে ওয়ার্ডে নিতে বাধ্য হন স্বজনরা। চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়ে চলে যাওয়ার সময়ও একইভাবে হয়রানির শিকার হন রোগী ও তাদের স্বজনরা। ভর্তি রোগীর জন্য বরাদ্দকৃত খাবারের মানও যাচ্ছেতাই। হাসপাতালের এ দুরবস্থার জন্য অদক্ষ প্রশাসনকে দায়ী করছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। তারা জানান, প্রায় ৭ বছর ধরে সহকারী পরিচালক, উপ-পরিচালক এবং সর্বশেষ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী স্বাচিপ নেতা ডা. কামরুল হাসান সেলিম নিজেই ছিলেন একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। দাফতরিক কাজকর্ম ছাড়া হাসপাতালের রোগী সেবার মান বাড়াতে তেমন কোনো পদক্ষেপ ছিল না তার। কর্মকালীন সময়ে একদিনের জন্যও তিনি ওয়ার্ড পরিদর্শন করেননি। তার সময় কেবল ভারী ভারী যন্ত্রপাতি কিনে নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজ নিয়ে পকেট ভারী করা হয়েছে। এরপর সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগের অধ্যাপক ডা. নিজাম উদ্দিন ফারুককে হাসপাতালের নতুন পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছে। নতুন পরিচালক এসেই হাসপাতালের দীর্ঘদিনের পুরনো বর্জ্য অপসারণের জন্য সিটি করপোরেশনকে আলটিমেটাম দেন। বিদ্যুৎ বিভাগকে হাসপাতাল চত্বর আলোকিত করার তাগিদ দেন। এমনকি তিনি নিজেই যখন-তখন বিভিন্ন ওয়ার্ড পরিদর্শন করছেন। নোংরা অস্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধময় ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভর্ৎসনা করছেন এবং দ্রুত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তবে নতুন পরিচালক যোগদানের পর কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলেও দাফতরিক কাজকর্মে তিনি ততটা অভিজ্ঞ নন বলে অনেকেই মনে করেন। এই হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রায়ই অক্সিজেন সিলিন্ডার সংকট দেখা দেয়। গত বছর যথাসময়ে অক্সিজেন না পাওয়ায় শিশুমৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। হাসপাতালে যে সংখ্যক অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকার কথা, বাস্তবে তা নেই। কারণ সরকারি হাসপাতালের অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়েই চলছে ব্যক্তি মালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স এবং ক্লিনিক। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মচারীদের মাসোহারা দিয়ে সরকারি অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালের শতাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডারের হদিস নেই বলেও জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র।

অভিযোগ অনুযায়ী, হাসপাতালের প্রধান ওষুধ স্টোরে চলছে সীমাহীন অরাজকতা। প্রধান ফার্মাসিস্ট নুরুল হক একই পদে ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করলেও হিসাব হালনাগাদ করেননি। চলতি বছর নতুন স্টোর অফিসার হিসেবে ডা. গোলাম মোস্তফা দায়িত্ব নেওয়ার পর অভ্যন্তরীণ যাচাই-বাছাই করেন। এতে ব্যাপক গরমিল ধরা পড়ে। তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন প্রধান ফার্মাসিস্ট। তারপর অসুস্থতার নামে চলছেন। এ কারণে আজ পর্যন্ত অতীতের হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে নতুন কাউকে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারেননি তিনি। বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে হাসপাতাল প্রশাসনও। জানা যায়, দু-একটি ছাড়া রোগ পরীক্ষার এমন কোনো যন্ত্র নেই যা এই হাসপাতালে নেই। কিন্তু নানা ছলচাতুরীতে বছরের বেশির ভাগ সময় সেগুলো অকেজো করে রাখার অভিযোগ রয়েছে। শত কোটি টাকার ভারী যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নেই কোনো প্রকৌশল বিভাগ। ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃত হোক একটি যন্ত্র বিকল হলে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ এসে সেটি মেরামত করতে অনেক সময় মাসও কেটে যায়। এই ফাঁকে যোগসাজশে লাভবান হন রোগ পরীক্ষার ব্যবসায়ীরা। অভিযোগে আরও জানা যায়, দলীয় প্রভাবের কারণে হাসপাতালে কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অনেক কর্মচারী দিনের শুরুতে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। কেউ কেউ ব্যস্ত থাকেন ব্যবসা, রোগীর দালালিসহ আয়বর্ধক ধান্ধা নিয়ে। প্রতিটি শিফটে ৫-৬ জন করে নার্স প্রতিটি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও বাস্তবে ২-৩ জনের বেশি থাকেন না। হাসপাতালে বিত্তবান রোগীদের জন্য ভাড়ার বিনিময়ে বিশেষ শয্যার (পেয়িং বেড) ব্যবস্থা রয়েছে। এ ভাড়ার টাকার সঙ্গেই রয়েছে তাদের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা। কিন্তু পেয়িং কেবিন ও পেয়িং বেডে থাকা রোগীরা কখনোই হাসপাতালের খাবার পান না। তাদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আÍসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব দুরবস্থার বিষয়ে ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ৫০০ শয্যার হাসপাতালে গড়ে রোগী থাকে ১২০০। ৫০০ রোগী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন হাসপাতালের ১৬ দারোয়ানের স্থলে আছে ৯ জন, ১৮০ ঝাড়–দারের জায়গায় আছে ৫৪ জন, ২২৫ এমএলএসএসের জায়গায় আছে ১১৮ জন এবং জমাদ্দার-সরদারের ২০ পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৮ জন। এদের বেশির ভাগের চাকরির বয়স ৫০ বছরের বেশি। গড়ে এদের এক-তৃতীয়াংশ থাকেন অসুস্থ। এরা কর্মঅক্ষম-বয়সে। নতুন নিয়োগ না হওয়ায় সমস্যা প্রকট হয়েছে। নবাগত পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিজাম উদ্দিন ফারুক জানান, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রোগী সেবার মান বাড়াতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু জনবলের অভাবে কাক্সিক্ষত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর শূন্য পদে ডাক্তার এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে লোক নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে জনবল নিয়োগ দেওয়া না হলে দিন দিন হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থার অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর