বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অর্থ পাচারে বেপরোয়া পোশাকশিল্প মালিকরা

রুহুল আমিন রাসেল

দেশে শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন প্রধান রপ্তানিমুখী খাত তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার মালিকরা। বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষি করে সুবিধা আদায় তাদের নিত্যদিনের ঘটনা। শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানির শর্তে আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি, আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা, কম দামে কেনা পণ্যের বেশি মূল্য দেখানো, আবার বেশি দামে বিক্রি করা পণ্যের দাম কাগজপত্রে কম দেখানো ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি এবং অর্থ পাচার করছেন পোশাকশিল্প মালিকরা।

দেশের অনেক পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানের গুরুতর আর্থিক অনিয়ম অনুসন্ধান করে এ তথ্য পেয়েছে স্থানীয় সরকার ও রাজস্ব অডিট অধিদফতর। এ সংস্থাটি বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম উত্থাপন করে তাদের কাছ থেকে শুল্ক ফাঁকির অর্থ আদায় করতে বলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরকে। এ প্রসঙ্গে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমি জানি না কারা এ অনিয়ম করে। তবে পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুণ করে যারা এ অনিয়ম করে বা করছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে দ্রুত ও কঠোর আইনি পদক্ষেপ চাই।’ তথ্যমতে দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। এ সংস্থাটির আর্থিক দুর্নীতি দেখার এখতিয়ার থাকলেও, রাজস্ব ফাঁকি দেখতে পারে না। মূলত আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টিও জড়িত। তবে এনবিআর ছাড়া রাজস্ব ফাঁকি কেউ ধরতে পারে না। আবার দুর্নীতি-রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে নানা আর্থিক অনিয়মের বিষয়টিও জড়িত। দেশে এ অনিয়মের মধ্য দিয়েই অর্থ পাচার হয়। পুরো আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে দেশের আরেক সাংবিধানিক-স্বাধীন প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির গোয়েন্দা শাখা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিএফআইইউ মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারসহ আর্থিক খাতের বড় বড় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। এনবিআরের কর গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলÑসিআইসি বড় ধরনের রাজস্ব ফাঁকি চিহ্নিতকরণের কাজ করে আসছে। বাংলাদেশে গত এক দশকে ১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটিÑজিএফআই। ‘ডিসেম্বরে, ২০০৩ থেকে ২০১২ পর্যন্ত উন্নœয়নশীল দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাচার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এক বছরের ব্যবধানে তিন গুণ বেড়েছে। ২০১২ সালে দেশ থেকে ১৭৮ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বর্তমানের বিনিময় হারের বিবেচনায় বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছর ২০১১ সালে পাচার হয়েছিল ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৪ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ১ হাজার ৩১৬ কোটি ডলার। প্রতি ডলার সমান ৭৮ টাকা ধরলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। রপ্তানির ক্ষেত্রে কম মূল্য দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং) ও আমদানির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং নানাভাবে পুঁজি দেশের বাইরে নেওয়ার মাধ্যমে ওই পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। গত এক দশকের বিবেচনায় বাংলাদেশ অর্থ পাচারের তালিকায় ৫১ নম্বরে রয়েছে উলে­খ করে জিএফআই বলেছে, ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের মধ্যে ৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার গেছে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। বিগত এক দশকে দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের আয়কর ফাইল অনুসন্ধান ও তদন্ত করে মাত্র ১ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা কর ফাঁকির সন্ধান পেয়েছে সরকারের কর গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলÑসিআইসি। সিআইসি প্রকাশিত ‘কর সুশাসনে গোয়েন্দা ও অনুসন্ধান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্থিক অপরাধ অন্য সব অপরাধের মূল। এমন অপরাধের মধ্যে রয়েছে চোরাচালান, অর্থ পাচার, মাদক পাচারে অর্থায়ন, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, বৈদেশিক মুদ্রা জাল, ঘুষ ইত্যাদি। এ ধরনের অপরাধ দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি বলেও মনে করছে সিআইসি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচারের প্রবণতার কারণেই দেশে দুর্নীতি হচ্ছে।

এ ছাড়াও রয়েছে সুশাসনের অভাব। রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ করা গেলে দুর্নীতি অনেকাংশে কমবে বলে মনে করেন কর বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তাদের মতে, রাজস্ব ফাঁকি কমলে অর্থ পাচারও কমবে। কারণ, কর দেওয়া অর্থ কেউ পাচার করতে উৎসাহিত হবে না। বরং তখন পাচারের পরিবর্তে বিনিয়োগ বাড়বে বলেও মত সংশ্লিষ্টদের। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন। অর্থ পাচার ও দুর্নীতিতে রাজস্ব ফাঁকি থাকে বলে মত দেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর