বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গ্রিসে সব হারিয়ে আজ তারা নিঃস্ব

আ স ম মাসুম, গ্রিস সীমান্ত থেকে

বলকান এলাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ ম্যাসিডোনিয়া। দেশটি ঘিরে রেখেছে একদিকে সার্বিয়া, একদিকে তুরস্ক, একদিকে সদ্য স্বাধীন হওয়া কসোভো আর অন্যদিকে গ্রিস। মূলত শরণার্থীরা আসছেন তুরস্ক থেকে গ্রিস হয়ে ম্যাসিডোনিয়া, সেখান থেকে সার্বিয়া হয়ে ক্রোয়েশিয়া-অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানি। এ পুরো জার্নিটা যেভাবে এক লাইনে বললাম বিষয়টি যদি তেমনি সহজ হতো তাহলে শরণার্থীদের নিয়ে এ রিপোর্ট লেখার প্রয়োজন ছিল না। সেই তুরস্ক থেকে গ্রিসের দ্বীপ লেসবসে আসতে গিয়েই মারা যায় আয়লান আল কুর্দি, সমুদ্র সৈকতে ভেসে আসা যার ছবি থেকেই মূলত ভাগ্যে পরিবর্তন আসে সিরিয়া থেকে জীবন বাজি রেখে আসা লাখ লাখ শরণার্থীর। জার্মানি খুলে দেয় তাদের দরজা। গোটা ইউরোপ শরণার্থীদের গ্রহণে নমনীয় হয়। মধ্যপ্রাচ্য আর আফগানিস্তান থেকে শরণার্থীরা তুরস্ক থেকে লেসবস দ্বীপ, সেখান থেকে জাহাজে করে ১৮ ঘণ্টায় গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে। যেহেতু শরণার্থীরা এক দেশে ৭২ ঘণ্টার বেশি থাকার সুযোগ পায় না সেহেতু এর মধ্যেই তাদের চলে আসতে হয় অন্য দেশের উদ্দেশে। এথেন্স থেকে ম্যাসিডোনিয়ার গ্যাবগেলিজা বর্ডারে আসতে লাগে বাসে প্রায় ৫ ঘণ্টা। সেখানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা কখন ম্যাসিডোনিয়া পুলিশ তাদের ঢুকতে দেবে ক্যাম্প এলাকায়। এ অপেক্ষার সময় কী হয় তা দেখার জন্য দিন কয়েক আগে পুলিশের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করি গ্রিসের সীমানায়, যেখানে রাতের অন্ধকারে বসে আছেন হাজার হাজার শরণার্থী! দেখে মনে হচ্ছে অনেকটা পশু বসিয়ে রাখা হয়েছে। হাতের মোবাইল ফোনের লাইটে দেখলাম তাদের চেহারা! চমকে ওঠার মতো সুন্দর সব শিশু, তুলনা করলে একমাত্র ফুলের সঙ্গেই করা যায়! নারী-পুরুষ সবার চেহারাই বলে তাদের ছিল সুরম্য বিশাল অট্টালিকা, ছিল সুন্দর বাগান, ব্যাংকভর্তি টাকা। পরিপূর্ণ জীবন ছিল যাদের তারাই আজ পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখে! তাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে চ্যারিটি সংস্থা। সঙ্গে থাকা যুক্তরাজ্যভিত্তিক আল-খায়ের ফাউন্ডেশন নামের একটি আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থার ম্যাসিডোনিয়ার কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেভস হাদিস আলিজার সহায়তায় আরবি ভাষাভাষীদের সঙ্গে কথা বললাম। জানলাম তাদের দুঃখের কাহিনী! যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা কত ভয়াবহ! কতটা বিপর্যয়ে পড়লে বাবা-মা সন্তান নিয়ে সাগরে ঝাঁপ দেন! নাইঝার নামের এক ৩২ বছরের যুবক যখন তার পাঁচ বছরের ফুটফুটে সন্তানকে পাথরের ওপর শুইয়ে আমাকে ছলছল চোখে জিজ্ঞাসা করেন তখন আমারই বা কী বলার থাকে! মুহাম্মদ শাকুর নামের ৭০ বছরের একজন বললেন, আমাদের তো সবই ছিল! এই আমরা জীবনের তাগিদে এখানে নিঃস্ব হয়ে এসেছি! আজ সময়ের ফেরে আমরা ভিক্ষুক! হাদিস আলিজা এখানে তার টিম নিয়ে কাজ করছেন গত মে থেকে। জিজ্ঞাসা করলাম এ ক্যাম্পে কেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে শরণার্থীদের! হাদিস ম্যাসিডোনিয়ার নাগরিক হয়েও এখানকার ‘সিস্টেমের’ ওপর খুবই বিরক্ত! তারা প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার শরণার্থীকে এখানে খাবার দিচ্ছেন, দিচ্ছেন গরম কাপড়। এ সহায়তা তাদের সংস্থা থেকে। এর মধ্যে যাদের ক্যাম্পে ঢোকানো হচ্ছে তাদের ৭২ ঘণ্টার থাকার অনুমতি দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তুলে দেওয়া হয় সার্বিয়ার বর্ডারের দিকের ট্রেনে। এ ক্যাম্পের জন্য বিশেষ প্লাটফরম বানিয়ে এখানে ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। হাদিস অভিযোগ করেন, ম্যাসিডোনিয়ার সরকার এই শরণার্থীদের ওপর জুলুম করছে। একে তো ক্যাম্পের ভিতর তাদের ওপর কোনো ভালো ব্যবহার করা হয় না, তার ওপর আবার যেখানে সবার জন্য ট্রেনের টিকিট ৬ ইউরো সেখানে শরণার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ২৫ ইউরো করে! গত মে থেকে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার ৪০ লাখ ইউরো আয় করেছে শরণার্থীদের কাছে টিকিট বিক্রি করে! আর ক্যাম্পের ভিতর যাচ্ছেতাই ব্যবহার তো আছেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর