রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বার্ধক্যে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

বার্ধক্যে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল বয়সের ভারে যেন ন্যূব্জ। বয়স এখন ১০০ বছর। তাই হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে নানা রোগ বাসা বাঁধতে বাঁধতে এখন তা মহীরুহের

আকার ধারণ করেছে। এই রোগ বা অন্তহীন সমস্যা দূর করতে অনবরত আবেদন-নিবেদন করা হচ্ছে। চিঠির পর চিঠি পাঠাতে পাঠাতে কর্তৃপক্ষ এখন পুরো হাঁপিয়ে উঠেছেন। কিন্তু টনক নড়ছে না উচ্চ পর্যায়ের। ফলে বার্ধক্য নিয়ে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে চলার মতো অবস্থা হয়েছে এ হাসপাতালের।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের পাঁচটি এক্স-রে মেশিনের দুটি গত ৮ বছর ধরে এবং বড় ডিজিটাল মেশিনটি গত তিন মাস ধরে নষ্ট। দুটি অ্যাম্বুলেন্সের একটি পড়ে আছে দুই বছর ধরে। দুটি জেনারেটরের একটি বাক্সবন্দী আছে ১০ বছর। নবজাতক শিশুর জরুরি চিকিৎসায় ইনকিউবেটর নেই, নেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ), কিডনি, লিভার, ক্যান্সার ও ফিজিওথেরাপি বিভাগ। ওষুধ রাখার মতো স্টোর রুমও নেই। লক্করঝক্কর ১৫টি আলমারি থাকলেও ঠাণ্ডায় ওষুধ রাখার মতো ফ্রিজেরও ব্যবস্থা নেই। লিফটের স্পেস থাকলেও লিফট নেই। অন্তঃবিভাগের শৌচাগারগুলোর অবস্থা নাজুক। মেঝেতে জমে থাকে পানি। ভেঙে গেছে দরজা। নেই নিজস্ব নলকূপের ব্যবস্থা ও তত্ত্বাবধায়কের গাড়ি। পাহাড়ের চূড়ায় ওয়ার্ডের অবস্থান, কিন্তু সেখানে উঠার মতো নিজস্ব যানবাহন নেই। ফলে মুমূর্ষু ও গাইনি রোগীদের অবস্থা হয় কাহিল। বাবুর্চি, নিরাপত্তা প্রহরী, আয়া, ওয়ার্ড বয়ের পদ নেই। এসব চলছে আউটসোর্সের মাধ্যমে। ১৫০ শয্যার রোগীর ওষুধ ও খাবার পাচ্ছেন ২৫০ শয্যার রোগী। কোনো কোনো রোগীর মতে, এই হাসপাতাল রোগীর চিকিৎসা করবে কি? হাসপাতাল নিজেই তো রোগী! তত্ত্বাবধায়ক ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী বলেন, ‘সমস্যার পাহাড় নিয়ে চলছি। এখনো ব্যবহার হচ্ছে ১৯১১ সালের পানির ট্যাংক। তারপরও নানাভাবে সেবা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তা ছাড়া বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় চিঠি লেখা হয়েছে। সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর হাসপতালের চিকিৎসক সংকট নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও বিএমএ চট্টগ্রামে লিখিত জানিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। কোনো ফল হয়নি।’ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, গত দুই বছরে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক অন্তত অর্ধশত চিঠি লিখেছেন। কিন্তু ফল হয়নি। জানা যায়, ১৯০১ সালে কেবল বহির্বিভাগ নিয়ে চালু হয় এ জেনারেল হাসপাতালটি। ১৯৮৬ সালে নতুন ভবন নির্মাণের মাধ্যমে ৮০ শয্যার হাসপাতালের যাত্রা শুরু। ১৯৯৬ সালে ১৫০ শয্যায় উন্নীতের জন্য নতুন ভবন নির্মিত হলেও জনবল কাঠামো অনুমোদন না হওয়ায় তা কার্যকর হয়নি। ২০০৩ সালে আগের জনবল দিয়ে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ১৫০ শয্যার জনবল ঠিক রেখেই ২৫০ শয্যার অনুমোদন দেয় সরকার। ১৫০ শয্যার জন্য তত্ত্বাবধায়ক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে ১৭৮টি মঞ্জুরিকৃত পদ থাকলেও ২০টি খালি। তবে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে ১০ জন করে ওয়ার্ড বয়, আয়া ও ঝাড়ুদার, চারজন কুক মশালচি, একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান ও একজন মালি কাজ করছেন। 

মুমূর্ষু রোগীকেও ফেরত যেতে হয় : ১৬ অক্টোবর। রাঙ্গুনিয়া থেকে আবুল কালাম (৩৮) নামের একজন বুকে ব্যথা ও কাশি নিয়ে দুপুর ১টায় আসেন হাসপাতালে। ততক্ষণে বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টার বন্ধ! জরুরি বিভাগে গেলেও চিকিৎসক তাকে পরদিন সকালে বক্ষ্যব্যাধি হাসপাতালে যেতে বলেন। কালাম বলেন, ‘গ্রাম থেকে টাকা খরচ করে ভালো চিকিৎসার জন্য আসছি। এখন দেখি গাড়ি ভাড়াও বিফলে গেল।’    

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে শিশু, মেডিসিন, গাইনি, সার্জারি, অর্থোপেডিক, নাক-কান-গলা, চর্ম ও যৌন, দন্ত, চক্ষু বহির্বিভাগ আছে। এসব বিভাগে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত টিকিটধারী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার কথা। তবে রোগীদের অভিযোগ, দুপুর ১২টার পর হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেখা মেলে না। অন্যদিকে ২টা পর্যন্ত বহির্বিভাগে টিকিট বিক্রি করার কথা থাকলেও ১টার পর রোগীরা টিকিট পান না। প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ৩০ জন রোগীকে চিকিৎসা না নিয়ে ফেরত যেতে হয়। ফারজানা নামের এক রোগী অভিযোগ করে বলেন, ‘এলার্জি সমস্যা নিয়ে প্রায় দুই মাস আগে বহির্বিভাগের চিকিৎসক অনি অয়েন্টমেন্ট ও হিস্টাসিন ট্যাবলেট দেন। কিন্তু না কমায় দুই মাস পর একই বিভাগে গেলে আবারও সেই দুটি ওষুধ দেওয়া হয় আমাকে। আগেও একই ওষুধ দেওয়ার কথা চিকিৎসককে জানালে তিনি এগুলো খেলে ভালো হবে বলেন।’ অভিযোগ অনুযায়ী, ৪৫ শয্যার শিশু স্বাস্থ্য, ৫০ শয্যা করে গাইনি-মেডিসিন-সার্জারি, ১২ শয্যা করে অর্থোপেডিক ও নাক কান গলা, ৭ শয্যার চক্ষু ওয়ার্ডেও যথা সংখ্যক চিকিৎসক থাকেন না। হাসপাতালে স্থায়ী ও প্রেষণে মিলে ৮৫ জন চিকিৎসক থাকলেও ওয়ার্ডে পাওয়া যায় না তাদের। প্রতি ওয়ার্ডে দুজন করে চিকিৎসক দায়িত্বে থাকার কথা থাকলেও অনেক সময় একজন পাওয়াও মুশকিল হয়। ৮৫ জন স্থায়ী নার্সের মধ্যে প্রতি ওয়ার্ডে তিনজন করে থাকার কথা থাকলেও থাকেন একজন। রোগীদের আরও অভিযোগ, বহিঃর্বিভাগে হাতেগোনা কয়েকজন কনসালটেন্ট ছাড়া অন্যরা ভালো করে রোগী দেখেন না। আর জরুরি বিভাগে অনেক সময় কঠিন সমস্যার চিকিৎসাও সীমাবদ্ধ থাকে ‘প্যারাসিটামল ও হিস্টাসিন’-এ। ফলে অবহেলার শিকার হন গরিব-দুস্থরা।

এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী বলেন, ‘অন্তঃবিভাগে চিকিৎসক সংকটের কারণে ওয়ার্ডে বিভিন্ন সময় চিকিৎসক থাকেন না। তবে চিকিৎসকদের বলেছি, ওয়ার্ডের রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে। অতীতে সিভিল সার্জন ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক থাকার সুবাধে বিভিন্ন স্থান থেকে চিকিৎসক প্রেষণে আনতাম। এখন আর সেই সুযোগ নেই।’

টাকা ছাড়া মুক্তি মেলে না ওটি রোগীর : ব্যবসায়ী মৃদুল গুহের স্ত্রী অপারেশনে সন্তান প্রসব করেন। ওটি থেকে রোগীকে বের করার সময় বিপত্তি বাধায় ‘একটি চক্র’। দিতে হবে এক হাজার টাকা। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়েই ওয়ার্ডে আসতে হয় মৃদুলকে। এভাবে হাসপাতালের ওটির রোগী থেকে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা অলিখিতভাবে বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয়। না দিলে নানা আপত্তিকর ঘটনাও ঘটে। ‘অল্প সময় ও রোগীর সেবার’ বিষয়টি বিবেচনা করে কেউ মুখ খোলেন না বা অভিযোগ করেন না বলে রোগীরা বলেন।  অভিযোগ আছে, অপারেশনের পর রোগীদের ওয়ার্ডে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব হাসপাতালের এমএলএসএস (চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া) কয়েকজনের। এ সুযোগে তারা রোগীদের ওটি থেকে বের করার পর স্বজনদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করেন। স্বজনরাও রোগীর স্বার্থে টাকা দিতে বাধ্য হন। ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী বলেন, ‘এ অভিযোগটি আমরা শুনি। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। অল্প বেতনের চাকরি। টানা চার-পাঁচ মাস পর্যন্ত তাদের বেতনও বন্ধ থাকে। তারা হয়তো রোগীদের কাছ থেকে কিছু টাকা আবদার করে। এ ব্যাপারে তাদের সতর্ক করে দেওয়া হবে।’

জানা যায়, এখানে দুটি ওটিতে মাসে গড়ে ১৫০ থেকে ১৬০টি অপারেশন হয়। তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সরকারি সেবাকেন্দ্রে ২টার পর অপারেশন হয় না। মুমূর্ষু রোগী ও  জরুরি ডেলিভারি রোগীদের চমেক হাসপাতাল কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীদের। হাসপাতালের ওটি বিভাগে একজন এনেসথেশিয়ালিস্ট ও দুই কনসালটেন্টের পদ আছে। এর মধ্যে কনসালটেন্ট আছেন একজন। ফলে এনেসথেশিয়ালিস্ট ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে ২টার পর অপারেশন থিয়েটার চালু থাকে না। রোগীদের অভিযোগ, চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সেবাকেন্দ্রটি চরম অবহেলিত। যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে এসব নেই। অথচ হাসপাতালের অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোসহ সব দিক দিয়েই ইতিবাচক। দরকার কেবল সরকারি পর্যায়ের আন্তরিকতা।

 

 

 

 

 

সর্বশেষ খবর