মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

৬৮ বছর পর দাশিয়ারছড়ায় দুর্গোৎসব

রফিকুল ইসলাম রনি ও আমিনুল ইসলাম, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) থেকে ফিরে

৬৮ বছর পর দাশিয়ারছড়ায় দুর্গোৎসব

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর দাশিয়ারছড়ায় এবারই প্রথম পালিত হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। গত ৬৮ বছরে এখানে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে দাশিয়ারছড়া যুক্ত হওয়ার পর প্রথম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে। অন্যদিকে যেসব পরিবার ভারতে যেতে ট্রাভেল পাস কাম পরিচয়পত্র নিয়েছে তাদেরও জন্মভূমিতে মিলেমিশে দুর্গোৎসবের আনন্দে মেতে ওঠার শেষ সুযোগ। এ নিয়ে দাশিয়ারছড়াসহ উপজেলার সর্বত্র হিন্দুধর্মালম্বীদের মাঝে বইছে উৎসবের আমেজ। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এবার ৬৭টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে দাশিয়ারছড়ার পূর্ব ছোট কামাত এলাকার মহানন্দ বিএসসির বাড়ির আঙিনা এবং কামালপুর উত্তর বড় কামাতে প্রতাপ চন্দ্রের বাড়ির পাশের মঠে প্রথম দুর্গাপূজা হচ্ছে। প্রতি মণ্ডপের ব্যয় নির্বাহের জন্য আধা টন করে চাল বরাদ্দ দেয়া হলেও দাশিয়ারছড়ার দুটি মণ্ডপের জন্য চাল ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগ থেকে দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া উৎসবের ব্যাপ্তি ঘটাতে পাড়া-মহল্লা ও ব্যক্তিগত উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহে নেমেছে দাশিয়ারছড়ার পূজা আয়োজনকারী যুবসমাজ। দাশিয়ারছড়ার পূর্ব ছোট কামাত গ্রামের ক্ষিতিশ চন্দ্র বর্মণ (৭৩) জানান এভাবে- ‘এবার হামরা প্রত্থম নয়া বাংলাত দুর্গাপূজা কইরবার নাগছি বাহে। ইয়ার আগোত হামরা নয়া বাংলার বাইরার মন্দিরত দুর্গা মার চরণত ফুল দিছি বাহে। এবার নিজের জাগাত সগায় মিলি একসঙ্গে পূজা করমো বাহে, কী যে আনন্দ নাইগবার ইয়াক আর কয়া শ্যাষ হবার নোয়ায়।’ গ্রামের ননীবালা অধিকারী বলেন, ‘এ্যাতদিন হামরা হিসাবোত আইছলংনা বাহে, এ্যালা শ্যাখের বেটি হামাক হিসাবোত নিলে। সেই জন্যে পূজা কইরবার চাইল দিছে, টাকা দিছে। ফির চকিদার, দাফাদার, আনসার-ভিডিপি পুলিশ হামাক পাহারা দিবার জন্যে দিয়া পাঠাইছে।’ বড় কামালপুর উত্তর ছোট কামাত পূজা আয়োজক কমিটির উপদেষ্টা প্রতাপ চন্দ্র বলেন, ‘এ্যাতদিন হামার মন মরা আছিল, দ্যাশ নাই, পরিচয় নাই, কোনঠো দেবীর পূজা করমো বাহে।’

সরেজমিন দাশিয়ারছড়া ঘুরে দেখা গেছে পূজাকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত গ্রাম কামালপুরের ছোট কামাত গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধদের মাঝে সাজসাজ রব। সবাই ব্যস্ত পূজার নানা উপকরণ সংগ্রহে। মহানন্দ বিএসসির বাড়ির আঙিনায় স্থাপন করা হয়েছে দুর্গা মন্দির। নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্ধ থেকে ১০ হাজার টাকায় কিনে আনা হয়েছে দুর্গামূর্তি। বানানো হয়েছে মূর্তি রাখার ঘর, আরতির স্থান। মূর্তির ঘরের দুই পাশে মেলার দোকান বসেছে। গজা, মুড়ি-মুড়কি, নারকেলের নাড়ু, বিভিন্ন খেলনা, পূজার সামগ্রী, পাটিসহ দেশীয় নানা জিনিসের দোকান। মন্দির এলাকায় বাজছে কাঁসর, সানাইয়ের বাদ্য আর উলুধ্বনি; যেন এক মহামিলনের ক্ষেত্র। এ মন্দিরের পূজা আয়োজক মহানন্দ অধিকারী জানান, ‘পূজার মূল পর্ব ছাড়াও থাকবে রাধাকৃষ্ণ কীর্তন পদাবলি, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রসাদ বিতরণ। এবারই প্রথম স্বাধীন দেশে পূজা উদ্যাপন করছি। এর আগে সর্বজনীন দুর্গোৎসব আয়োজন সম্ভব হয়নি।’ ভারতে যাওয়ার আগে জন্মস্থানে সবার সঙ্গে পূজা করতে পারব এটা ভেবে খুশি লাগছে বলে জানালেন হরেন্দ্র বর্মণ (৭২)। ‘এবার শেষ দুর্গোৎসবে মেতে উঠব’ বলে জানালেন ভারতগামী যুবক ভবেশ চন্দ্র রায় (৩২)। দ্বিজেন চন্দ্র বর্মণ (৭৫) বলেন, ‘এবার সরকার সদয় হয়েছে, সরকারি সাহায্যে তাই পূজা আয়োজন করতে পারছি। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।’ এ গ্রামে ৩০টি হিন্দু পরিবারে প্রায় ১০০ লোকের বাস। এর মধ্যে ১১টি পরিবারের ৪৫ জন ভারতে যেতে ট্রাভেল পাস কাম পরিচয়পত্র নিয়েছেন। কামালপুর উত্তর বড় কামাত গ্রামে দেখা যায়, পূজামণ্ডপে ভিড় করছে ছোট-বড় সবাই। সবার মাঝে উৎসবের আমেজ। এ গ্রামের বিরো বালা (৩২) বলেন, ‘এবার হামরা একসঙ্গে দুই খুশি পালন কইরবার নাগছিবাহে। এক নয়া বাংলাদেশি, দুই প্রথম দুর্গাপূজা।’ ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের সাবেক নেতা এবং আওয়ামী লীগের দাশিয়ারছড়া ইউনিটের আহ্বায়ক আলতাব হোসেন জানান, ‘৬৮ বছর পর প্রথম দাশিয়ারছড়ায় শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করছে প্রায় ১২০টি পরিবারের ৪৬৯ জন মানুষ।’ পূজা উদ্যাপন পরিষদ ফুলবাড়ী উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চন্দ্র সরকার জানান, ‘দাশিয়ারছড়ার সবাই মিলেমিশে দুর্গাপূজায় অংশ নিয়েছে এর জন্য খুব ভালো লাগছে। এবার নিজের জন্মভূমিতে একসঙ্গে পূজার আনন্দ অনাবিল।’

 

সর্বশেষ খবর