শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এমপির চিকিৎসায় স্কুল ফান্ডের ১০ লাখ টাকা

অদক্ষতা দুর্নীতি ও দলাদলিতে গুলশানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

সাঈদুর রহমান রিমন

অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় এমপির খবরদারিত্ব, অব্যাহত লুটপাট ও শিক্ষকদের দলাদলির কারণে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। প্রধান প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিতে এমপির আস্থাভাজনদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে শুরু হয়েছে অসন্তোষ। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দলাদলি গ্রুপিংকে ঘিরে গভর্নিং বডিতেও সংঘাত সংঘর্ষময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সব মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ার  পরিবেশ নেই বললেই চলে। ঐতিহ্যবাহী, নামিদামি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। কমে গেছে পাসের হারও। এসব স্কুলের তহবিল তসরুপ করে অর্থ লুটপাটেরও এন্তার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, গুলশানের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত কালাচাঁদপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডি দখলের চেষ্টার অংশ হিসেবে স্থানীয় এমপিপন্থি শিক্ষকরা স্কুলে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া থেকেও বিরত থাকছেন। ইতিমধ্যেই ওই স্কুলে ৬ শতাধিক শিক্ষার্থী কমে গেছে। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ে ৩ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা-১৭ আসনের সাবেক এমপি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এর ডিও লেটারের ভিত্তিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড মো. ওয়াকিল উদ্দিনকে সভাপতি করে ১১ সদস্যের গভর্নিং বডির অনুমোদন দেয়। কিন্তু ২০১৪ সালের ৬ মার্চ স্থানীয় এমপি এস এম আবুল কালাম আজাদ নিজেকে গভর্নিং বডির সভাপতি ঘোষণা দিয়ে একজন সহকারী শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান অধ্যক্ষের চেয়ারে বসান। এ নিয়েই দলাদলি, কোন্দলের সূত্রপাত ঘটে। এর জের ধরে এমপিপন্থি ২৬ জন শিক্ষক গত জুন মাস থেকেই স্কুলে আসা-যাওয়া বন্ধ রেখেছেন। শিক্ষক অভিভাবকরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ছাত্রছাত্রী কমেছে গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজেও। সেখানে হাইস্কুল বিভাগের ৪০০ শিক্ষার্থী এবং কলেজ বিভাগে ১০০ শিক্ষার্থী অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে। ঢাকা-১৭ আসনের এমপি এস এম আবুল কালাম আজাদ এ প্রতিষ্ঠানেরও গভর্নিং বডির সভাপতি হওয়ার পর থেকে দলাদলি, গ্রুপিং শুরু হয়। সেখানে এমপিপন্থি শিক্ষক ও এমপিপন্থি অভিভাবক সদস্যদের দাপটে বাকি সবাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া বনানী বিদ্যানিকেতন, বনানী মডেল স্কুল, মহাখালী আলিয়া মাদ্রাসাসহ গুলশানের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই কোন্দল, অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের গুলশানের বাইরের স্কুল-কলেজে সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। 

অনিয়ম, দুর্নীতি-লুটপাট চলছেই : গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ এম মুস্তফা জামান এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এমপি আবুল কালাম আজাদ পারস্পরিক যোগসাজশে কলেজটির টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের। তারা প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি জানিয়েছেন। গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আবদুল জব্বার মেহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট চলছেই।  এদিকে গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মুস্তফা জামান মিয়ার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুবার তদন্ত করে। এর মধ্যে গত ৬ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা শাখা থেকে সহকারী সচিব নূরজাহান বেগম স্বাক্ষরিত এক পত্রে দেখা যায়, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মোট ২৫টি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে ভর্তি ও পরীক্ষা কমিটি, বাড়ি ভাড়া, সনদ ভাতা প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনিয়ম, মামলার খরচের নামে শিক্ষকদের কাছে চাঁদাবাজি, স্কুলের টাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি কেনা, শিক্ষকদের সঙ্গে অশালীন ও অসদাচরণ, গভর্নিং বডিতে পছন্দের লোক বসাতে লবিং-গ্রুপিং, একাডেমিক ও শিফট ইনচার্জ নিয়োগে অনিয়ম, জিবির অনুমোদন ছাড়াই চুক্তিভিত্তিক শিক্ষককে চাকরিতে বহালসহ অনেক অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও অধ্যক্ষ বহাল থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। তারা জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষ ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মিলে দুর্নীতির দুর্গ গড়ে তুলেছে। চলতি বছরেই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিল থেকে ৩১ লাখ টাকা আত্মসাৎ, প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণকাজ থেকে ২০ লাখ টাকা কমিশন আদায় এবং আর্থিক সুবিধা নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই ১১ জন নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্কুলের তহবিল থেকে ৩৭টি চেকের মাধ্যমে প্রায় ৭৫ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪৪ লাখ টাকা শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হিসেবে  দেখানো হয়। এমপি আবুল কালাম আজাদের চিকিৎসা ব্যয় বাবদ ১০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হলেও বাকি ২১ লাখ টাকার হদিস মিলছে না।

এমপির বক্তব্য : ঢাকা-১৭ আসনে এমপি নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনএফ) সভাপতি এস এম আবুল কালাম আজাদ। তিনি গুলশানের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলাদলি, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, অর্থ লোপাটের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, ‘আমি যখন অসুস্থ ছিলাম তখন কলেজের শিক্ষকরা স্বেচ্ছায় ১০ লাখ টাকা আমার ব্যাংক হিসাবে পাঠিয়েছিলেন, আমার চিকিৎসার জন্য। তবে সে টাকা আমি ব্যবহার করিনি, বরং ফেরত দিয়ে দিয়েছি।  এ ব্যাপারে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য আবুল কাশেম বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো  কোনো এমপি স্কুল থেকে ১০ লাখ টাকা ধার নিয়েছেন। কলেজের সোনালী ব্যাংকের গুলশান শাখার অ্যাকাউন্ট  থেকে চেকের মাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্টে আবুল কালাম আজাদের হিসাবে ১০ লাখ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। চেকে অধ্যক্ষ মুস্তাফা জামানের পাশাপাশি আবুল কালাম আজাদ নিজেও স্বাক্ষর করেছেন।

 

সর্বশেষ খবর