সোমবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বনে সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ তবে বন্ধ নেই পাচার

অরক্ষিত সুন্দরবন ৫

সামছুজ্জামান শাহীন, সুন্দরবন থেকে ফিরে

বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো তৎপরতার মধ্যেও সুন্দরবনের বনজ সম্পদ পাচার থেমে নেই। থেমে নেই চোরাই শিকারিদের দৌরাত্ম্যও। বিশেষ করে সুন্দরবনের সৌন্দর্য সুন্দরী, পশুর, কাঁকড়া ও বাইন গাছ কেটে পাচারও হচ্ছে অহরহ। উপকূলের বসতি এলাকার কোথাও কোথাও প্রকাশ্যেই বেচাকেনা হচ্ছে সুন্দরবন থেকে চুরি করে আনা নানা প্রজাতির গাছের লগ (গুঁড়ি) বা জ্বালানি কাঠ।

জানা যায়, সিডর ও আইলার পর সুন্দরবন থেকে সব ধরনের সম্পদ আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। এরও বহু আগে থেকে কাটা নিষিদ্ধ করা হয় সুন্দরী, পশুর, কাঁকড়া, বাইন গাছ। সুন্দরবনের মধ্য থেকে রেণু পোনা আহরণও নিষিদ্ধ করা হয়। কাঁকড়া ও মাছ ধরার জন্যও এলাকা নির্দিষ্ট করে দেয় বন বিভাগ। কিন্তু এর কোনোটাই মানছে না এক শ্রেণির বনজীবী। তারা বৈধ পাস-পারমিট নিয়ে মাছ ধরতে বনে প্রবেশ করে। ফেরার সময় নিয়ে আসে বিপুল পরিমাণের নানা প্রজাতির গাছ বা জ্বালানি কাঠ। যা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিক্রি করছে লোকালয়ে। সরকারি ও বেসরকারি এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বর্তমানে দৈনিক গড়ে প্রায় তিন লাখ মানুষ মাছ, কাঁকড়া ও মধু সংগ্রহে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। এই বিপুল মানুষের প্রত্যেকে যদি সর্বনিম্ন এক মণ করে কাঠ কেটে নেয়, তার মোট পরিমণ অনেক বড় দাঁড়ায়।

সরেজমিন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী ও ধামরাইল এলাকায় সুন্দরী গাছের অসংখ্য ছোট বড় টুকরোসহ বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কাঠ বিকিকিনি দেখতে পাওয়া যায়। এই দুই এলাকায় বড় বড় কাঠের তৈরি জলযানের মেরামতে সুন্দরী গাছের প্রকাশ্য ব্যবহারও চোখে পড়ার মতো। কয়রা উপজেলায় কয়েকটি ফার্নিচারের দোকানে আসবাবপত্র তৈরি হচ্ছে পশুর, কাঁকড়া ও বাইন গাছ দিয়ে। সরকারি চাকুরে কর্মকর্তারাও এসব আসবাবের ক্রেতা। একই সঙ্গে কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলা সদরের হোটেল, রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকানে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সুন্দরবনের গাছ। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ থেকে শুরু করে এনজিও কর্মী, বাসা-বাড়িতে ও শুঁটকি মাছ তৈরির কাজেও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সুন্দরবনের সুন্দরীসহ নানা প্রজাতির গাছ। আবার সুন্দরবনের শক্ত প্রজাতির গাছ বিশেষ করে সুন্দরী ও গরান পুড়িয়ে কয়লাও (চারকল) তৈরি হচ্ছে। উপকূলের থানা, ফাঁড়ি ও ক্যাম্পগুলোর ব্যারাকের রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সুন্দরবনের নানা প্রজাতির কাঠ! অথচ বন আইনে যা একেবারেই নিষিদ্ধ। গতকাল পশ্চিম সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ স্টেশনের কাছাকাছি একদল জেলেকে সুন্দরী গাছের বড় বড় টুকরো কাঁধে করে নামাতে দেখা যায় বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পশ্চিম সুন্দরবনের কোবাদক, নলিয়ান ও বানিয়াখালী, কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন এলাকা থেকে বেশির ভাগ সুন্দরী, কাঁকড়া, বাইন, পশুর গাছ পাচার হচ্ছে। পাচারকারী চক্র গাছ কেটে নির্দিষ্ট মাপে টুকরো করে তা বিশেষ কায়দায় ট্রলারের নিচে লুকিয়ে সাতক্ষীরা শ্যামনগরের দুর্গম এলাকা পারশেমারি, গাবুরা, পাতাখালী, খুটিকাটা, চণ্ডীপুর নওয়াবেকি, পাখিমারা, আশাশুনির কুড়িকাউনিয়া, একশরা, চাকলা, রুইয়ের বিল ও শুভদ্রাকাঠি এলাকায় বিক্রি করছে। একাধিক বনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পশ্চিম সুন্দরবনের গাছ পাচারকারী চক্রটি মূলত খোলপেটুয়া, চৌদ্দরশি, কপোতাক্ষ নদকে পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করে। এসব নদীপথে বন বিভাগের নিয়মিত পাহারা টহল না থাকায় পাচারকারী চক্র তাদের গাছ পাচারের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বিনা বাধায়। একই অবস্থা সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে। এই বিভাগ থেকে চোরাই কাঠগুলোর বেশির ভাগ নদীপথেই চলে যায় স্বরূপকাঠি মোকামে। সেখানকার স-মিলগুলোতে চোরাই হয়ে চলে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। বনদস্যুরা বনজীবী নির্ভর দস্যুতার পাশাপাশি এখন বিভিন্ন বন্যপ্রাণী বিশেষ করে বেঙ্গল টাইগার শিকার করে এর চামড়াসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার করছে। এ চক্রটি দেশি-বিদেশি একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় র‌্যাব ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। জানা যায়, র‌্যাব, পুলিশ ও বনকর্মীরা যৌথভাবে এই চক্রটির মাঠ পর্যায়ের নেটওয়ার্ক ভাঙার চেষ্টায় অনেকটা সফল হয়েছেন। কিন্তু নেটওয়ার্কের উপরের দিকের ক্রীড়নকদের টিকিটিও ছুঁতে পারছেন না। সুন্দরবন বিভাগের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে সেসব ব্যক্তি সুন্দরবনের দস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের সম্পর্কে বন বিভাগের কাছে বিশ্বাসযোগ্য অনেক তথ্য আছে। কিন্তু বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়া ও অকাট্য প্রমাণ হাতে না থাকায় সেসব নিয়ন্ত্রকদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না। জানা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুন্দরবনে ও লোকালয়ে অভিযান চালিয়ে ৪টি বেঙ্গল টাইগারের চামড়া, হরিণের চামড়া ৫১টি, বাঘের হাড় ৬৯টি, দাঁত ২৯টি এবং বাঘের মাথা ১টি উদ্ধার করে। আবার বনের মধ্য থেকে নানা ধরনের অসংখ্য শিকার করার যন্ত্র বা ফাঁদ উদ্ধার করেছে বনকর্মীরা। এর মধ্যে শুধু গেল আগস্ট মাসে খুলনা মহানগরীর ও কয়রা উপজেলার লোকালয় থেকে ৪টি বাঘের চামড়া, ৬৯টি বাঘের হাড় উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর কোস্টগার্ড সদস্যরা দাকোপ উপজলা থেকে দুটি হরিণের চামড়া উদ্ধার করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরবন বিভাগের মাঠ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম সুন্দরবনের যে কোনো এলাকা থেকে অবৈধভাবে বনজ সম্পদ চুরি করে তা নদীপথ ছাড়া লোকালয়ে পৌঁছানো একেবারেই অসম্ভব। সুন্দরবনে প্রবেশ ও বের হওয়ার মুখে একাধিক ফরেস্ট স্টেশন ও ক্যাম্পের অবস্থান। তাদের সামনে দিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথও নেই। নিয়মিত পাহারা টহল থাকলে চোরাকারবারি চক্র ধরা পড়তে বাধ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য এক শ্রেণির বনকর্মী বিশেষ করে কাঠ চোরদের প্রশ্রয় দিয়ে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে।

সর্বশেষ খবর