বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আত্মপরিচয় সংকটে জাতীয় পার্টি

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

আত্মপরিচয় সংকটে জাতীয় পার্টি

আত্মপরিচয় সংকটে ভুগছে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। এইচ এম এরশাদ মন্ত্রী মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং দলের তিনজন প্রেসিডিয়াম সদস্য মন্ত্রিপরিষদে থাকায় ‘সরকারি’ না ‘বিরোধী দল’ এমন আত্মপরিচয় সংকট। এইচ এম এরশাদ প্রতিনিয়ত সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করলেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হওয়ায় বিরোধী দলের প্রধান হিসেবে তা আমলে নিচ্ছেন না খোদ দলের নেতা-কর্মীরাই। পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ও মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু দলকে সংগঠিত করার জন্য সারা দেশে একের পর এক কর্মসূচি পালন করে চললেও বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। এদিকে রবিবার টিআইবি দশম সংসদের দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ অধিবেশন সম্পর্কে পার্লামেন্টওয়াচ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে প্রধান বিরোধী দলের প্রত্যাশিত ভূমিকা অনুপস্থিত থাকার কথা উলে­খ করা হয় এতে। এতে বলা হয়, কথিত প্রধান বিরোধী দল সরকারের কার্যক্রমের বিরোধিতার পরিবর্তে স্তুতি এবং সরকারি দলের সিদ্ধান্তের সপক্ষে নজিরবিহীন লেজুড়বৃত্তির কারণে সংসদের প্রত্যাশিত কার্যকরতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দশম সংসদের দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ অধিবেশনে সংসদ নেতার উপস্থিতি ছিল মোট কার্যদিবসের ৮৩ শতাংশ এবং বিরোধীদলীয় নেতার উপস্থিতি ছিল ৫৭ শতাংশ। এতে বলা হয়, কথিত প্রধান বিরোধী দল সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে প্রত্যাশিত জোরালো ভ‚মিকার ঘাটতি এবং অসংসদীয় আচরণ ও ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারের শক্তিশালী ভ‚মিকার অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা, বিভিন্ন কাজের পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান ও অনুরোধ ব্যতীত জোরালো সমালোচনা করে প্রধান বিরোধী দলকে প্রত্যাশিত অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া সংসদের বাইরের রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলকে সম্মিলিত সুরে আক্রমণাত্মক সমালোচনায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। তবে টিআইবির এমন মন্তব্য মানতে নারাজ জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টিআইবি নিজেই অন্যের রশিতে নাচছে। পেছন থেকে কেউ রশি নাড়ছে আর টিআইবি পুতুলনাচ দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রধান বিরোধী দল নিয়ে টিআইবি যা বলেছে তা সত্যের অপলাপ। তিনি বলেন, টিআইবির যদি চোখ-কান খোলা থাকত তাহলে এমন কথা বলতে পারত না। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছি জাতীয় সংসদে। এর প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছি। ঘাটতি বাজেটের কঠোর সমালোচনা করেছি। বিশ্বজিৎ ও রাজন হত্যাকাণ্ডের সময় সংসদ অধিবেশন ছিল না সে জন্য পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ রাজপথে মানববন্ধন করেছেন। এ ছাড়া সারা দেশে মানববন্ধন করে বিচার চেয়েছে জাতীয় পার্টি। শুক্রবারও জাতীয় পার্টির কাকরাইলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশে পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বলেছেন, বর্তমানে গণতন্ত্র কবরে স্থান পেয়েছে।’ এইচ এম এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং তিনজন প্রেসিডিয়াম সদস্য মন্ত্রিপরিষদে থাকায় পার্টি আত্মপরিচয় সংকটে আছে কি না? দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ আছে কি না? জানতে চাইলে জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, ‘বিরোধী দল থেকে মন্ত্রিপরিষদে শুধু বাংলাদেশে নয়, এটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানে আছে, অতীতেও ছিল।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি শ্রীলঙ্কা, জার্মানি ও ভারতের কথা উলে­খ করেন। তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে দলে কোনো বিভ্রান্তি নেই। নেতা-কর্মীদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলেছি। মন্ত্রিপরিষদ থেকে বেরিয়ে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি দলীয় সিদ্ধান্ত। জানা যায়, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী, মজিবুল হক চুন্নু শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ও মশিউর রহমান রাঙ্গা সমবায় মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। নেতা-কর্মীরা বলছেন, জাতীয় পার্টিতে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক নিপীড়ন-নির্যাতন, কিংবা ধরপাকড় সামলাতে না হলেও শুধু ‘সরকারি দল’ না ‘বিরোধী দল’ এ রকম আত্মপরিচয় সংকটে থাকার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। অথচ এরশাদের রয়েছে অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকার। বর্তমান আত্মপরিচয় না থাকায় ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে দলটি। জাপা সরকারি দল না বিরোধী দল, বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়ার কারণে অনেক নেতা-কর্মী দল ছাড়ছেন। এ ছাড়া পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের মতবিরোধ অনেকটা প্রকাশ্য। এরশাদ দল পরিচালনা করছেন। সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য এ বয়সেও তিনি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছেন। তিনি অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপিকে পাশে পাচ্ছেন না। মন্ত্রী-এমপিরা রওশন এরশাদের সঙ্গে থাকেন। তাদের দলের কার্যক্রমে খুব একটা দেখা যায় না। তবে পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ দলীয় প্রধানের সঙ্গে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যান। কারণ হিসেবে জেলা নেতারা বলছেন, ‘আমরা ২২৭ জন বিভিন্ন জেলার নেতা স্যারের নির্দেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছি। এখন স্যার আমাদের কোনো খোঁজ নেন না। এ ছাড়া ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলায় আমরা যারা নির্বাচন বর্জন করেছিলাম, তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ জাপার প্রেসিডিয়ামের কয়েকজন সদস্য ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, সরকারের ভেতরে এক পা এবং বাইরে এক পা রেখে রাজনীতি করছে জাপা। দলটি না সোনার বাটি, না পাথরের বাটি। নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার না হওয়ায় দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা দ্বিধাদ্বদ্ন্বে ভুগছেন।

সর্বশেষ খবর