রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কুমির রপ্তানিতে বিস্ময় বাংলাদেশ

জিন্নাতুন নূর

কুমির রপ্তানিতে বিস্ময় বাংলাদেশ

দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশই বাণিজ্যিকভাবে কুমির রপ্তানি করছে। গত অর্থ বছরে দুটি বেসরকারি কুমির ফার্মের মধ্যে একটি থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার কুমিরের চামড়া রপ্তানি করা হয়। এ ফার্মের নাম রেপটাইল ফার্ম লি.। এ ছাড়া ২৯০টি কুমিরও রপ্তানি হয়। সংশ্লিষ্টরা    আশা করছেন, প্রতি বছর চার হাজার কুমিরের চামড়াসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রপ্তানি করা গেলে বছরে ৩০ কোটি টাকার বেশি আয় করা সম্ভব। এরই মধ্যে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে কুমির আমদানির প্রস্তাব দিয়েছে। এদিকে নাইক্ষ্যংছড়িতে কুমির চাষ শুরু হয়েছে। এটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কুমির চাষ প্রকল্প।

জানা গেছে, বহির্বিশ্বে ২৫ ডলারে (১ হাজার ৯৫০ টাকা) কেজিতে কুমিরের মাংস বিক্রি হয়। আর কুমিরের ১ বর্গ সে.মি. চামড়ার দাম ১২ ডলার (৯৩৫ টাকা)। দেশে প্রথম ২০০৯ সাল থেকে কুমিরের চামড়া রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে রপ্তানির পরিমাণ কম হলেও ২০১২ সাল নাগাদ সব মিলিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২ কোটি টাকা। কুমির রপ্তানিকারকরা জানান, বর্তমানে লাভজনক এ খাতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও রপ্তানি কাজে সহযোগিতার মাধ্যমে খামারিদের কুমির চাষে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। তারা জানান, এখনো তারা কুমিরের মাংস রপ্তানি করার জন্য প্রস্তুত নয়। কারণ এখনো কুমিরের মাংস প্রক্রিয়াজাত করার সুযোগ-সুবিধা গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সাধারণত বিভিন্ন কৃষিজ, মৎস্যজাত ও ওষুধ পণ্যসহ নানা পণ্য রপ্তানি হয়। রপ্তানি আয়ের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অংশ আসে পোশাক খাত থেকে। তবে কুমির রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা নতুন আশার আলো দেখছেন। এরই মধ্যে কুমির চাষ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কুমির চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কয়েক বছরের মধ্যেই কুমির চাষের মাধ্যমে কয়েক গুণ মুনাফা করা সম্ভব। ময়মনসিংহের ভালুকায় রেপটাইল ফার্ম লিমিটেডের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম দেশে কুমিরের চাষ শুরু হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে এ ফার্ম থেকেই প্রথম কুমির রপ্তানি হয়। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে এটি শুরু হয়। এ ফার্মের সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, কয়েক বছরের মধ্যেই বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকার চামড়া বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ভালুকায় ১৫ একর জায়গায় গড়ে উঠেছে এ ফার্ম। জানা যায়, ২০০৪ সালে মালয়েশিয়া থেকে ৭৫টি বয়স্ক কুমির নিয়ে মোস্তাক আহমেদ ও মেজবাউল হকের উদ্যোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক সহয়তায় এ ফার্ম শুরু হয়। সে সময় সাতটি কুমির মারা যায়। বাকি ৬৮টির মধ্যে ১৪টি পুরুষ এবং ৫৪টি স্ত্রী কুমির। ২০০৬ সালে প্রথম তিনটি বাচ্চা পাওয়া যায়। ২০০৭ সালে বাচ্চার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১টিতে। বর্তমানে ১ হাজার ৬০০-এর কাছাকাছি। কুমির চাষ পদ্ধতির প্রাথমিক খরচ কিছু বেশি হলেও কুমির চাষ দেশের আবহাওয়ায় উপযোগী। ২০০৯ সালে জার্মানির হাইডেল বার্গ ইউনিভার্সিটির সঙ্গে রেপটাইল ফার্মের রপ্তানি চুক্তি হয়। আর ২০১০ সালে জার্মানিতে ৭০ লাখ টাকার বিনিময়ে ৬৭টি কুমির রপ্তানি করা হয়। এ ছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয় আরও ২২৩টি কুমির। তারা ১ হাজার কুমির রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছে। রেপটাইল ফার্ম লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুশতাক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ১০ বছরে বিশ্ববাজারে কুমির রপ্তানি করে বাংলাদেশ ভালো একটি অবস্থান তৈরি করেছে। চাহিদা থাকায় বিশ্বব্যাপী কুমিরের জন্য নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে। এ খাতে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা লাভজনক অবস্থানে যেতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাসী। আশা করছি, আরও বিনিয়োগকারী এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। এতে দেশে কুমির বাণিজ্য ঘিরে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। এরই মধ্যে রেপটাইল ফার্ম ইউরোপের কয়েকটি দেশ থেকে কুমিরের চামড়া রপ্তানির প্রস্তাব পেয়েছে। ফার্মের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, কুমিরের মাংস ও চামড়া রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাই ছিল এ ফার্মের উদ্দেশ্য। গত ডিসেম্বরে ৪০০ কুমিরের চামড়া একটি জাপানি ফার্মে বিক্রি করে এ প্রতিষ্ঠান। এ বছর রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়বে। ময়মনসিংহ ছাড়াও আরেকটি বেসরকারি কুমিরের ফার্ম হচ্ছে আকিজ গ্রুপের আকিজ ওয়াইল্ড লাইফ ফার্ম লিমিটেড। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তুমব্রু গ্রামে এ ফার্ম অবস্থিত। ৩০ একরের বেশি পাহাড় ঘিরে কুমিরের এই প্রজননকেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়। ২০০৯ সালে পাহাড়ের বিশাল অংশজুড়ে কুমির চাষের জন্য এ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। তবে নাইক্ষ্যংছড়ির কুমির চাষ প্রকল্পের উৎপাদন শুরু হলেও কুমির রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কুমির চাষ প্রকল্প। এখানে ৩১টি মাদি কুমির এর মধ্যে ৩০০ বাচ্চা প্রসব করেছে। ২০১০ সালে এখানে পরীক্ষামূলকভাবে ৫০টি কুমির উš§ক্ত জলাশয়ে ছাড়া হয়। এখন জীবিত আছে ৪৭টি কুমির। এ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আবদুল আজিজ জানান, কুমির রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি মাসে তাদের খরচ হয় গড়ে দেড় লাখ টাকা। এর বাইরে সরকারি অর্থায়নে সুন্দরবনের আরেকটি কুমির চাষ প্রকল্প আছে। তবে এটি এখনো বাণিজ্যিক উদ্দেশে কুমির রপ্তানিতে যায়নি। উল্লেখ্য, কুমিরের চামড়া দিয়ে বেল্প ও পার্স তৈরি হয়। হাড় দিয়ে পারফিউম, দাঁত দিয়ে গহনা তৈরি হয়। এ ছাড়া ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, চীন, স্পেন, তাইওয়ান, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর এবং চীনে কুমিরের মাংস ও চামড়ার ব্যাপক চাহিদা আছে।

সর্বশেষ খবর