রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

৫০ শয্যার জনবলে ৫০০ শয্যার শহীদ তাজউদ্দীন হাসপাতাল

খায়রুল ইসলাম, গাজীপুর

৫০ শয্যার জনবলে ৫০০ শয্যার শহীদ তাজউদ্দীন হাসপাতাল

চিকিৎসক সংকট, প্রয়োজনীয় লোকবল ও অবকাঠামোর অভাবসহ নানা সমস্যার মধ্যে চলছে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্যক্রম। আগের ৫০ শয্যা গাজীপুর সদর হাসপাতালের জনবল দিয়েই চলছে ৫০০ শয্যার এই হাসপাতাল। সম্প্রতি গাজীপুর সদর হাসপাতালের জন্য নির্মিত একটি ভবনে চলছে কলেজ ও হাসপাতালের শিক্ষা কার্যক্রম। ফলে এলাকাবাসী গাজীপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ৫০০ শয্যার জন্য অনুমোদিত জনবল নিয়োগের জন্য ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র প্রক্রিয়াধীন। পর্যায়ক্রমে নতুন পদগুলো পূরণ করা হবে। ৫০০ শয্যা হাসপাতালের অবকাঠামোও নির্মাণ শেষ হলে আর সমস্যা থাকবে না। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট জয়দেবপুর থানা হেলথ কমপ্লেক্স’ নামে হাসপাতালটির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৪ সালে একই ভবনে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট থানা হেলথ কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করে ‘জেলা সদর হাসপাতাল, গাজীপুর’-এ রূপান্তর করা হয়। ভৌত অবকাঠামো ঠিক রেখে এমনকি জনবল না বাড়িয়ে রোগীদের সেবার স্বার্থে ২০০৪ সালের জুলাই থেকে এটিকে ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ২০১৩ সালের ২২ আগস্ট ১০০ থেকে ৫০০ শয্যায় রূপান্তরিত করে নাম দেওয়া হয় ‘৫০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল ও ট্রমা সেন্টার, গাজীপুর’। ২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর থেকে হাসপাতালের নতুন নামকরণ করা হয় ‘শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, গাজীপুর। পরবর্তী সময়ে সদর হাসপাতালের জন্য সম্প্রসারণ করা ভবনেই শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়।

গাজীপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. আবদুস সালাম সরকার জানান, ৫০ শয্যা হাসপাতালের জনবল দিয়েই ৫০০ শয্যার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি চলছে। বর্তমানে নয়জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নয়জন মেডিকেল অফিসার এবং ডেপুটেশনে আটজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও দুজন মেডিকেল অফিসার হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছেন। হাসপাতালটির পুরো চিকিৎসা কার্যক্রম চালাতে কমপক্ষে ১০০ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। এখানে নিউরো মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। হাসপাতালে কোনো ইনডোর মেডিকেল অফিসার নেই। আউটডোরের মেডিকেল অফিসাররাই পালাক্রমে জরুরি বিভাগ ও ইনডোর মেডিকেল অফিসারের কাজ করে থাকেন। প্রতিদিন বহির্বিভাগে প্রায় ৭০০ ও জরুরি বিভাগে দুই থেকে আড়াইশ রোগী আসে। ৯ শতাধিক রোগীর ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা দিতে প্রতি পদের বিপরীতে আরও চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। বর্তমানে হাসপাতালের ১০০টি শয্যা রয়েছে। স্থান ও শয্যার অভাবে অনেক রোগীকে বারান্দার মেঝেতে রেখেই চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে গাজীপুর সদর হাসপাতালের নতুন ভবনে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়ায় রোগীদের এ স্থানাভাব আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া নার্স রয়েছে ৯০ জন, ঝাড়–দার চারজন, ডোম একজন। ইলেকট্রিশিয়ান ও জুনিয়র মেকানিক নেই। প্রতিমাসে এখানকার মর্গে কমপক্ষে অর্ধশত লাশের পোস্টমর্টেম হয়ে থাকে। ফ্রিজিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় বেওয়ারিশ লাশগুলো বেশিদিন মর্গে রাখা সম্ভব হয় না। হাসপাতালের নিরাপত্তার জন্য নাইটগার্ড প্রয়োজন হলেও এর কোনো পদ নেই। নাইটগার্ড না থাকায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী ও স্বজনরা থাকেন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। হাসপাতালে দুটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও একটি নষ্ট। একজন মাত্র চালক রয়েছেন। মুমূর্ষু রোগীদের জন্য অধিক ভাড়ায় বাইরের অ্যাম্মু^লেন্স ভাড়া করতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা। হাসপাতালের চিকিৎসকদের যাতায়াতের জন্য কোনো যানবাহন নেই। এখানে নেই কোনো ট্রমা সেন্টার। চিকিৎসক মো. আবদুস সালাম সরকার জানান, দুটি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনই অচল থাকায় রোগীরা এ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিদ্যুতের লো-ভোল্টেজের কারণে এক্স-রে ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি চালানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০ রোগীর এক্স-রে করা প্রয়োজন। রোগীদের অভিযোগ এক্স-রেসহ অন্যান্য পরীক্ষা তারা বাইরের ক্লিনিক থেকে করিয়ে আনতে বাধ্য হন। এ হাসপাতালের আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার বাসিন্দা কামরুল। তার হাত ভেঙে গেলে তাজউদ্দীন হাসপাতালে চিকিৎসা করালেও বেশি টাকা খরচ করে এক্স-রে করাতে হয়েছে বাইরের ক্লিনিক থেকে।  

রোগীদের অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চিকিৎসকদের নিজ নিজ কক্ষে থাকার কথা। কিন্তু সকাল ১০টার আগে আউটডোরে কোনো চিকিৎসকের দেখা মেলে না। ফলে যেসব রোগী সকালে সেবা নিতে হাসপাতালে যান, তাদের অপেক্ষায় থাকতে হয়।

হাসপাতাল ভিতরে ও বাইরে বহিরাগত দালালদের দৌরাÍ্য চরম আকার ধারণ করেছে। তারা ভিন্ন স্থানে চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলে ভাগিয়ে নিয়ে যায় রোগীদের। এ ব্যাপারে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক জানান, জনবলের অভাব ও সিকিউরিটি না থাকায় তাদের প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বেশির ভাগ রোগীকেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় রেফার করা হয়। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ, ইনজেকশন থেকে শুরু করে দামি ওষুধের সবই রোগীকে বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। হাসপাতালের আরএমও জানান, ‘আউটডোরে ওষুধের সংকট নেই। আমরা বরাদ্দ অনুযায়ী রোগীদের মধ্যে তা বিতরণ করি।’ শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. সুবাস চন্দ্র সাহা জানান, ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট ১৫ তলা হাসপাতাল ভবনের মধ্যে আটতলা নির্মাণের কাজ ২০১৪ সালের ৯ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা ছিল। আটতলা ভবন নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। এখন চলছে ফিনিশিংয়ের কাজ। আশা করা যায় আগামী বছরের জুন মাসে ভবনটি হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রমের পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে। ভবন নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্যক্রমও শুরু হবে। সংযুক্তির মাধ্যমে এখানে ৫০ জন শিক্ষক দিয়ে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের অ্যানাটমি, ফিজিওলজি ও বায়োক্যামিস্ট্রি বিভাগের ক্লাস চলছে। এ জন্য অত্যাধুনিক দুটি লেকচার হল, ছয়টি টিউটোরিয়াল রুম, তিনটি ল্যাবরেটরি, দুটি ডিসেকশন হল ছাড়াও অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের জন্য আর ৪০টি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। গাজীপুরের সিভিস সার্জন ডা. মো. আলী হায়দার খান জানান,  ৫০০ শয্যার জন্য অনুমোদিত জনবল নিয়োগের জন্য ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র প্রক্রিয়াধীন। পর্যায়ক্রমে নতুন পদগুলো পূরণ করা হবে। ৫০০ শয্যা হাসপাতালের অবকাঠামোও নির্মাণাধীন। আশা করা হচ্ছে আগামী জুন-জুলাইয়ের দিকে ভবনটি আমরা প্রস্তুত পাব। তখন আর সমস্যা থাকবে না।

সর্বশেষ খবর