রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
নয়া দিল্লির চিঠি

দাদরির সেই বিসারা গ্রামে

ঋতুপর্ণা রায়

গোমাংস নিয়ে বিতর্কের জেরে নয়াদিল্লি উত্তাল। সরকারি খেতাব ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা থেকে কেরল ভবনের সামনে প্রতিবাদের উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশজুড়ে। কিন্তু দিল্লি থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে, সাম্প্রতিক বিতর্কের আঁতুড়ঘর, গো মাতার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে একাট্টা। দুই বছর পর উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। এখন থেকেই গোমাতা বিতর্ককে এখান থেকেই সামনে রেখে মেরুকরণের রাজনীতিকে ধীরে ধীরে উচ্চগ্রামে নিয়ে যেতে চলেছে বিজেপি তা গ্রামবাসীদের সমস্বর, শিবমন্দিরের জটলা আর গ্রাম প্রধানের মজলিস থেকে স্পষ্ট। এক মাস আগের মুহাম্মদ আখলাকের ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়ে, একটি আপাত শান্তির বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে গৌতম বুদ্ধনগরের দাদরির জেলার এই রাজপুত অধ্যুষিত বিসারা গ্রামে। সেই ‘শান্তির’ বলয়ে একজনই ভিলেন। তিনি আর কেউ নন, খোদ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব। ‘এখানে গত ১০০ বছর ধরে কয়েক ঘর মুসলমান বাস করেন। তাদের খাদ্যাভ্যাস হিন্দুদেরই মতো। কিন্তু এই অখিলেশ এসে মুসলমানদের চরিত্র নষ্ট করছেন। তাদের বিপথে চালিত করছেন।’ সেই শিব মন্দিরটির সামনে খাটিয়ায় সদ্য নরম হওয়া রোদে আরাম করে বসে রয়েছেন ধর্মবীর সিংহ। এই গ্রামেরই একটি গমকলের মালিক। এখানকার গত ৪০ বছরের বাসিন্দা। তার অভিযোগ, আখলাকের মৃত পরিবার পেল ৪০ লাখ টাকা। নয়ড়ায় তিনটি ফ্ল্যাট। অথচ এ ঘটনার পরেই অভাবের জ্বালায় গলায় দড়ি দিল গরিব কৃষক রাম অবতার। কই, তখন তো কোনো সরকারের টনক নড়ে না।’ গত বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে সব বর্ণের হিন্দুকে ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ করার কৌশল নিয়েছিল আরএসএস তথা সংঘ পরিবার। এখন পর্যন্ত এ গ্রামে আরএসএস তকমা লাগানো কর্মীদের যাতায়াতের কোনো খবর নেই। কিন্তু, ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে প্রশাসনিক কর্তা বা সমাজবাদী পার্টির মন্ত্রী যতবার এসেছেন, তার চারগুণ যাতায়াত বেড়েছে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী তথা গৌতম বুদ্ধনগরের বিজেপি সংসদ সদস্য মহেশ শর্মার। দিল্লি থেকে ফাঁক পেলেই সপার্ষদ চলে আসছেন তিনি। গ্রামবাসীর সঙ্গে দেখা করছেন, বসছেন পঞ্চায়েতের সঙ্গে। স্থানীয় বিধায়ক বহুজন সমাজের নেতা সতবীর সিংহ গুর্জরের উপস্থিতি এবং প্রভাব কিন্তু সপা নেতাদের মতোই নিæগামী। গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সঞ্জীব রানার কথায়, ‘এখানে কোনো সমস্যা নেই। যা হয়েছে তা একটা দুর্ঘটনা মাত্র। কেজরিওয়াল, রাহুল গান্ধীর মতো নেতারা এসে পরিবেশ আরও খারাপ করে দিচ্ছেন। মানুষের মনে বিষ ঢোকাচ্ছেন।’ খুব বেশি হলে তিরিশ-পঁয়ত্রিশটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এই গ্রামে। গ্রামের ৮০ শতাংশ ঠাকুর। তাদের নিজেদের মধ্যেও জমিজিরেত নিয়ে বনিবনার অভাব, মতান্তর, ছোটখাটো হিংসার ঘটনা লেগেই থাকে। রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নেও সপা, বসপা এবং কংগ্রেসের সমর্থনেও বিভক্ত এই হিন্দু রাজপুতদের বিরাট ভোটব্যাংক। আখলাক হত্যাকাণ্ডের ফলে উঠে আসা ‘গোমাতা’র জাতীয়তাবাদকে আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা করে, এই বিভেদকে কমিয়ে একাট্টা করাটা বিজেপির কৌশলের মধ্যে পড়ে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। গ্রামে প্রতিনিয়ত সভা করে (যেখানে উপস্থিত থাকছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও) প্রধান সঞ্জীব রানা বলছেন, ‘গো মাতার সঙ্গে হাজার হাজার বছরের বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা জড়িয়ে রয়েছে। গাভীকে ভারতবাসী পূজা করে এসেছে। ফলে তার মাংস খাওয়ার প্রয়োজনটাই বা কী? মুরগি, ছাগল অনেক কিছুই তো রয়েছে। সেসব খেতে তো কেউ মানা করেনি।’ গ্রামে ঢোকার মুখেই একটি বড় মনোহারি দোকান। যার মালিক ওম বীর বলছেন, ‘এই গ্রামে তো কদাপি কোনো সাম্প্রদায়িক অশান্তিু ছিল না। আর থাকবেই বা কেন? রাজপুতরাই তো মসজিদের জমি, মুসলমান সম্প্রদায়ের থাকার জমি দিয়েছে। কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু গো হত্যার ঘটনা তো মেনে নেওয়া যায় না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর