সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিচার হয়নি কোনো খুনের

লাকমিনা জেসমিন সোমা

বিচার হয়নি কোনো খুনের

দিনদুপুরে একের পর এক খুন হচ্ছে ব্লগার। ঘটনার পর যথারীতি মামলা হচ্ছে, দু-চারজন আটক হচ্ছে। কিন্তু বিচার হচ্ছে না কারোরই। আর এভাবেই গত দুই বছরে দেশে পাঁচজন মুক্তমনা ব্লগার এবং একজন প্রকাশককে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। এর মধ্যে চলতি বছরেই আট মাসের মধ্যে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন পাঁচজন। সর্বশেষ গত শনিবার দুপুরে রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে গলা কেটে হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধর ফয়সল আরেফিন দীপনকে। আগের খুন হওয়া ব্লগারদের মতোই যথারীতি বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় শোকে স্তম্ভিত দীপনের বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি তাদের বিচার চাই না।’ জানা যায়, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে খুনের মাধ্যমে শুরু হয় সাম্প্রতিককালের ধারাবাহিক ব্লগার হত্যা। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নৃশংসভাবে খুন করা হয় মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশি ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়। অভিজিৎকে হত্যার এক মাসের মাথায় খুন হন ওয়াশিকুর রহমান। ঘটনার দুই মাস পরই মার্চে ঢাকার বাইরে সিলেটে খুন হন অনন্ত বিজয় দাস নামে আরেক ব্লগার। লেখালেখির অভিযোগে আগস্টে হত্যা করা হয় নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে। ব্লগারদের পর সবর্শেষ গত পরশু প্রথমবারের মতো হামলা করা হয় দুই প্রকাশকের ওপর। এতে নিহত হন দীপন। তিনি এর আগে খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বইয়ের অন্যতম প্রকাশক ছিলেন।

এসব হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিটি হত্যার ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো ধর্মীয় এবং মৌলবাদী সংগঠন দায় স্বীকার করেছে। মামলা হয়েছে। ঘটনার পরপরই রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে দোষারোপ শুরু করেছে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেই বিবৃতি, বিক্ষোভ কিংবা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে-তদন্ত চলছে, আসামি ধরা পড়বে, বিচার হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় এবং নতুন ঘটনার ঘনঘটায় এক সময় তলিয়ে গেছে এসব ইস্যু। এ পর্যন্ত সুষ্ঠু বিচার হয়নি কোনো ব্লগার হত্যাকাণ্ডেরই।

কচ্ছোপ গতিতে ব্লগার রাজিব হত্যার বিচার : যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন উত্তাল শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ, ঠিক তখনই ১৫ ফেব্রুয়ারি দুর্বৃত্তের চাপাতির আঘাতে পল্লবীতে নিজ বাসার সামনে খুন হন আন্দোলনে অংশ নেওয়া কর্মী আহমেদ রাজিব হায়দার। ব্লগে তিনি ‘থাবা বাবা’ নামে লিখতেন। ঘটনার পর জড়িত সন্দেহে সাতজনকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের তদন্তে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে উঠে আসে। মামলাটি পরে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ঘটনার দুই বছর পর গত ১৮ মার্চ এ আটজনকে আসামি করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের ৫৫ সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন আদালত। আগামী ৮ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।

এখনো অভিজিৎ হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি পুলিশ : চলতি বছর একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন অভিজিৎ রায়। মারাত্মক আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদ। এই হত্যা মামলায় সাতজনকে গ্রেফতার করা হলেও আজও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের একটি প্রতিনিধি দলও তদন্তের জন্যে ঢাকায় এসেছিল।

আসামি হাতেনাতে ধরা পড়লেও এখনো চলছে ওয়াশিকুর হত্যার বিচার : অভিজিৎ রায়কে হত্যার এক মাসের মধ্যেই গত ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে রাস্তার ওপর কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে। এ সময় হামলাকারীদের দুজনকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে প্রত্যক্ষদর্শীরা। এদের একজন পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এ হত্যা মামলায় আটক পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে গত সেপ্টেম্বরে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। অভিযোগপত্রে যাদেরকে আসামি করা হয়, তাদের তিনজন বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছেন। বাকি দুজন পলাতক। পলাতক দুজনের সম্পত্তি ‘ক্রোক’ করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিচারাধীন মামলাটি দেখছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।

অগ্রগতি নেই সিলেটের ব্লগার বিজয় হত্যা মামলার : গত ১২ মে দিনদুপুরে ব্যাংকে যাওয়ার পথে খুন হন সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। ঢাকার বাইরে এটাই একমাত্র ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। তিনিও ‘মুক্তমনা’ ব্লগে লিখতেন। এ ছাড়া সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। অনন্ত হত্যা মামলায় সিলেটের ফটো সাংবাদিক ইদ্রিস আলী ও মাহাইমিন নোমানকে গ্রেফতার করা হলেও আদালতে প্রয়োজনীয় নথি উপস্থাপন করতে না পারায় এখনো মামলার শুনানি শুরু হয়নি। এরই মধ্যে গত ২৮ অক্টোবর ইদ্রিস আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে গেছে। আটক অপর চারজন কারাগারে রয়েছে। এরপর এ মামলার আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

অন্ধকারেই নীলাদ্রি হত্যা মামলা : স্বাধীন মত প্রকাশের অপরাধে ব্লগারদের মধ্যে সর্বশেষ খুন হন নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। এই হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন দু-চারজনকে আটক করা হলেও প্রকৃত খুনিদের হদিস খুঁজে পাইনি পুলিশ। গত ৭ আগস্ট দুপুরে নিজ বাড়িতে খুন হন নীলাদ্রি। হত্যা মামলার তদন্তভার ডিবি পুলিশকে দেওয়া হলেও তা অন্ধকারেই থেকে গেছে। যদিও হত্যার পর জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করা হয়েছিল। জানা গেছে, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা চলাকালীন বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্তচিন্তাকারীদের ওপর হামলার ঘটনা। পরে ১২ আগস্ট জার্মানিতে নিজ বাসায় অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় তার। এ ঘটনার ১১ বছর পার হলেও এখনো বিচার কাজ শেষ হয়নি। মামলাটি এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এরপর সংঘটিত একের পর এক হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। চূড়ান্ত রায় বা বিচার পায়নি কেউ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর