সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

লালমনিরহাট হাসপাতালের ভরসা প্যারামেডিকস ও টেকনিশিয়ানই

রেজাউল করিম মানিক, লালমনিরহাট

লালমনিরহাট হাসপাতালের ভরসা প্যারামেডিকস ও টেকনিশিয়ানই

জনবল সংকটে কাহিল হয়ে পড়েছে লালমনিরহাট সদর হাসপাতাল। জেলার ১৪ লাখ মানুষের উন্নত চিকিৎসার একমাত্র ১০০ শয্যার এ হাসপাতালটি কার্যত চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। চিকিৎসক সংকটের কারণে হাসপাতালটি চলছে প্যারামেডিকস ও ডেন্টাল টেকনিশিয়ান দিয়ে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্নীতি আর লুটপাটের মহোৎসব। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোগীদের জন্য সরকারিভাবে এই হাসপাতালে প্রতিবছর প্রায় কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার আধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি কেনা  হলেও রোগীদের তা করাতে হয় বাইরে থেকে। ‘ডিজিটাল এক্সরে মেশিন নেই’ অজুহাতে হাসপাতালে আসা রোগীদের ডিজিটাল এক্সরে করাতে বাইরে ব্যক্তিমালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। রোগীদের অভিযোগ, এক্সরে ও প্যাথলজি বিভাগের টেকনিশিয়ান ও বহির্বিভাগের ডাক্তাররা হাসপাতালের আশপাশের কয়েকটি ডিজিটাল এক্সরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। টেকনিশিয়ানদের ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায় এ হাসপাতালে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন কেনা হয় না। হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগের রোগী, তাদের স্বজন এবং ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম-দুর্নীতি আর দলবাজি গ্রাস করে আছে জেলার চিকিৎসার একমাত্র এ হাসপাতালটি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সপ্তাহের দুই দিন মাংস, দুই দিন ডিম ও দুই দিন মাছ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সপ্তাহজুড়েই দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের সিলভার কার্প মাছ। অভিযোগ অনুযায়ী, হাসপাতালের প্রধান ওষুধ স্টোরে চলছে সীমাহীন অরাজকতা। প্রধান ফার্মাসিস্ট অনিল চন্দ্র একই পদে ২০ বছরেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করলেও হিসাব হালনাগাদ করেননি। অধিকাংশ ওষুধই কালোবাজারে বিক্রি করে তা লুটপাট করা হচ্ছে। দু-একটি ছাড়া রোগ পরীক্ষার এমন কোনো যন্ত্র নেই যা এই হাসপাতালে নেই। কিন্তু নানা ছলচাতুরীতে বছরের বেশির ভাগ সময় সেগুলো অকেজো করে রাখার অভিযোগ রয়েছে। কোটি টাকার ভারী যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নেই কোনো প্রকৌশল বিভাগ। ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃত, একটি যন্ত্র বিকল হলে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ এসে সেটি মেরামত করতে কয়েক মাস কেটে যায়। এই ফাঁকে যোগসাজশে লাভবান হন রোগ পরীক্ষার ব্যবসায়ীরা। জানা যায়, দলীয় প্রভাবের কারণে হাসপাতালে কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অনেক কর্মচারী দিনের শুরুতে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। কেউ কেউ ব্যস্ত থাকেন ব্যবসা, রোগীর দালালিসহ আয়বর্ধক ধান্ধা নিয়ে। প্রতিটি শিফটে পাঁচ-ছয়জন করে নার্স প্রতিটি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও বাস্তবে দু-তিনজনের বেশি থাকেন না। হাসপাতালে বিত্তবান রোগীদের জন্য ভাড়ার বিনিময়ে বিশেষ শয্যার (পেয়িং বেড) ব্যবস্থা রয়েছে। এ ভাড়ার টাকার সঙ্গেই রয়েছে তাদের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা। কিন্তু পেয়িং কেবিন ও পেয়িং বেডে থাকা রোগীরা কখনোই হাসপাতালের খাবার পান না। তাদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রায়ই অক্সিজেন সিলিন্ডার সংকট দেখা দেয়। গত বছর যথাসময়ে অক্সিজেন না পাওয়ায় শিশুমৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। হাসপাতালে যতসংখ্যক অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকার কথা, বাস্তবে তা নেই। কারণ সরকারি হাসপাতালের অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়েই চলছে ব্যক্তিমালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স ও ক্লিনিক। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মচারীদের মাসোহারা দিয়ে সরকারি অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালের অর্ধশত অক্সিজেন সিলিন্ডারের হদিস নেই বলেও জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে হয়রানির ঘটনা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কতিপয় অসাধু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে রোগীদের ভালো চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিকে প্রেরণের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। অপ্রয়োজনে বিভিন্ন ডায়াগনোসিস আইটেমের তালিকা রোগীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চিকিৎসকের পছন্দের ক্লিনিকে যেতে বাধ্য করার ঘটনা ঘটছে। অন্যথায় রিপোর্ট ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ ছাড়া শল্যচিকিৎসার রোগীদের ক্ষেত্রে ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হিসেবে চালু থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে ৫০ শয্যার মঞ্জুরি করা ডাক্তারের পদ দিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। মঞ্জুরি করা ডাক্তারের ৩৯টি পদের মধ্যে ৩০টি পদই শূন্য। এসব পদের মধ্যে গাইনি ও মেডিকেল সিনিয়র কনসালটেন্ট, প্যাথলজি, অর্থোসার্জারি, রেডিওলজি, প্যাথলজিস্ট, জুনিয়র কনসালটেন্ট ও দুজন জরুরি মেডিকেল অফিসারের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। আবার কালেভদ্রে কোনো বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসক এখানে যোগদান করলেও তিনি যত দ্রুত সম্ভব বদলি হয়ে যান। লালমনিরহাট সদর হাসপাতাল থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজে রেফার হওয়া রোগীরা জানান, লালমনিরহাটে সুচিকিৎসা থাকলে রংপুরে যেতে হতো না। জানা যায়, ডাক্তার-স্বল্পতার কারণে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে মোগলহাট ইউনিয়নের প্যারামেডিকস আবির বিন আক্তার, হাসপাতালের ডেন্টাল টেকনিশিয়ান কবির হোসেন ও লালমনিরহাট পৌর এলাকার সাপটানা বাজার উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজাউল করিমকে দিয়ে জরুরি বিভাগ এবং আউটডোরে চিকিৎসার কাজ করানো হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক জানান, বর্তমান সরকারের আমলে জেলা সদরের এ হাসপাতালটিতে নজিরবিহীন বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক সংকট চলছে। তিনি জানান, সারা জেলার বাকি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবস্থাও প্রায় এক। এ ব্যাপারে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আজমল হোসেন জানান, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞসহ অন্যান্য ডাক্তার না থাকায় রোগীদের ভালো চিকিৎসার জন্য নিজস্ব ভাড়ায় হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়ে থাকে। লালমনিরহাট জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সামাদ  ডাক্তার সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, রংপুর হাসপাতালের ডাক্তারদের এ হাসপাতালে বদলি করে সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। কারণ অন্য এলাকার ডাক্তাররা এখানে এসে থাকতে চান না। হাসপাতালের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. নুক্ষুরুজ্জামান আহমেদ অভিযোগের বিষয়ে জানান, রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী অন্তত তিনটি এক্স-রে, একটি এমআরআই, একটি সিটিস্ক্যান, একটি অটো এনালাইজার, একটি বায়োকেমিস্ট্রি এনালাইজারসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ বা টেকনিশিয়ান প্রয়োজন থাকলেও আজ পর্যন্ত এসব শূন্যতা পূরণ হয়নি। ২৪ ঘণ্টার কাজ চালাতে এক্স-রে অপারেটর ছয়-সাতজনের স্থলে আছে মাত্র একজন, প্যাথলজি ল্যাবের কাজ চালাতে সাত-আটজনের স্থলে আছে মাত্র একজন। ১০০ শয্যার হাসপাতালে বরাদ্দকৃত ওষুধপথ্যে ২০০-৩০০ রোগীর সেবা দিতে হলে অতিরিক্ত ওষুধ বাইরে থেকে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এমন বাস্তব চিত্রে সেবা নিশ্চিত করা দুরূহ। এ সংকটের উত্তরণ ছাড়া রোগীদের অভিযোগ দূর করা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতির সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে ক্লিনিক ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র। তাদের পাল্লায় পড়ে রোগীরা সীমাহীন হয়রানির শিকার হয়ে চলেছেন। তার মতে, সীমাবদ্ধতার মধ্যে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর