বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অসুখে ভারাক্রান্ত খুলনার তিন সরকারি হাসপাতাল

সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা

অসুখে ভারাক্রান্ত খুলনার তিন সরকারি হাসপাতাল

খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে চার বছর আগে স্থাপিত ১০ শয্যার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটটি (আইসিইউ) এখনো চালু করা যায়নি। নামে ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে গত পাঁচ বছরে শয্যা চালু করা গেছে সাকল্যে ৮০টি। ১০টি বিভাগ খোলার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত চালু হয়েছে মাত্র পাঁচটি বিভাগ। আর এসব কিছুর পেছনে চিকিৎসক সংকট ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দকে দায়ী করেছে কর্তৃপক্ষ। শুধু এই হাসপাতালই নয়, ৫০০ শয্যা ঘোষিত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও প্রাচীনতম খুলনা জেনারেল হাসপাতালের একই অবস্থা। জনবল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে ধুঁকছে হাসপাতাল দুটি। জানা যায়, খুলনার তিনটি সরকারি হাসপাতালেই হৃদরোগে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের অতিপ্রয়োজনীয় আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) চিকিৎসাসেবা নেই। ফলে এসব রোগীকে শরণাপন্ন হতে হয় নগরীর বেসরকারি দুটি হাসপাতালে, যেখানে প্রতিদিন আইসিইউ ভাড়া গড়ে পাঁচ থেকে ১২ হাজার টাকা। গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের রোগীদের এ সেবা গ্রহণ অনেকটা দুরূহ বলেই বিনা চিকিৎসায় জীবনপ্রদীপ নিভে যায় কারও কারও। আবার উপায় না দেখে ওই সব প্রতিষ্ঠানে গেলেও পরে সহায়-সম্বল বিক্রি করে বিল পরিশোধ করতে হয়। খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি আশরাফ উজ জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলোতে জরুরি স্বাস্থ্য পরিসেবা থাকাটাই তো দরকার। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থে এ ধরনের সেবা চালু করা হয় না, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।’ তিনি বলেন, ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-জনবল সংকট, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, নোংরা পরিবেশ, বিছানার অভাবে মেঝেতে রেখেই চিকিৎসা, ওষুধ ও রোগীর পথ্য সরবরাহে সিন্ডিকেট, বেসরকারি হাসপাতালের প্যাথলজি ব্যবসা, দালালসহ নানা চক্রের উৎপাত-খুলনার তিন সরকারি হাসপাতাল এসব সমস্যায় জর্জরিত। এর অবসান হওয়া দরকার।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি এই তিন প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক-কর্মচারীদের দিয়ে চলছে নগরীর শতাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সরকারি হাসপাতালের লোকজন দিয়ে পরিচালিত হওয়ায় তাদের পাশাপাশি রোগীরাও জিম্মি হয়ে পড়ে ওই সব প্রতিষ্ঠানের কাছে। সরকারি হাসপাতালের প্যাথলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কয়েক গুণ কম হলেও নানা অজুহাত ও প্রক্রিয়ার ফাঁদে সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হন সাধারণ রোগীরা। হাসপাতালের রোগী ও স্বজন, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম-দুর্নীতি গ্রাস করেছে খুলনার আধুনিক চিকিৎসার ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিত সরকারি এই তিন হাসপাতালে।

শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল : খুলনাবাসীর আন্দোলনের ফসল শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল। শুরুটা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের হাত দিয়ে। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকার এসেই শুধু নামের কারণে সার্বিক উন্নয়ন বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়। পুনরায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে হাসপাতালটিতে যেনতেনভাবে চিকিৎসাসেবা চালু করলেও এখনো নানা সংকট পিছু ছাড়ছে না। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকট প্রকট। প্রতিদিন গড়ে ১০০ রোগী আলট্রাসনোগ্রাম করতে এলেও নানা সংকটে ২৫-৩০ জনের বেশি রোগীর পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। বাকি ৭০-৭৫ জন দালালের হাত ধরে চলে যান বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। একই সঙ্গে এমআরআই মেশিনটি মাঝেমধ্যেই নষ্ট থাকে। চিকিৎসক সংকটে রিপোর্ট পেতে সময় লাগে তিন থেকে পাঁচ দিন। অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালে এমআরআই করতে তিন হাজার টাকা ফি দিতে হয়। একই পরীক্ষা করাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দিতে হয় আট থেকে ১০ হাজার টাকা। একইভাবে সিটিস্ক্যানের জন্য সরকারি হাসপাতালে দুই হাজার টাকা লাগলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নেওয়া হয় প্রায় চার হাজার টাকা। একইভাবে সরকারি হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্যাম্পল (নমুনা) গ্রহণ করা হয় সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত। রিপোর্ট দেওয়া হয় বেলা দেড়টা থেকে ২টা পর্যন্ত। কিন্তু হাসপাতালের বহির্বিভাগে যেসব রোগী আসেন তাদের চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র নিতেই বেলা ১১টা পার হয়ে যায়। ফলে অনেকেই ওই দিন স্যাম্পল দিতে পারেন না। আবার হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে গেলেও যখন রিপোর্ট পাওয়া যায়, ততক্ষণে চিকিৎসক হাসপাতাল ত্যাগ করেন। ফলে সময় বাঁচাতে রোগীরা বাধ্য হয়ে বাইরের প্যাথলজি সেন্টার থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে বাধ্য হন। এভাবে প্রতিনিয়তই রোগীদের সঙ্গে রীতিমতো প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্যাথলজি সেবা নিতে চাইলেও সেটি সম্ভব হয় না। কারণ অধিকাংশ চিকিৎসক-কর্মচারী বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে জড়িত, যে কারণে তারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। চিকিৎসক নির্দেশিত প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট না দেওয়া হলে রোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণও করা হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩০ মার্চ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু হলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় নিউরোসার্জারি, প্লাস্টিক ও রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারিসহ বার্ন ইউনিট, ইলেকটিভ অর্থোপেডিক, ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট ও রিসেপশন বিভাগ চালু করা যায়নি। প্যাথলজি বিভাগে বর্তমানে ডা. সুকুমার সাহা ও ডা. মনোয়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রিপোর্ট দেন। চাপ সামলাতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডা. গাজী সালাউদ্দিনকে এখানে ডেপুটেশনে আনা হয়েছে। নিউরোসার্জারি বিভাগে ডা. মোহসিন আলী ফরাজী বহির্বিভাগে রোগী দেখলেও আর কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় অন্তর্বিভাগ চালু করা যায়নি। এ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. এম এ আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কার্ডিয়াক বিভাগে এনজিওগ্রামসহ রিং পরিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় রিং বরাদ্দ নেই। এ বিভাগের সঙ্গে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ থাকাটা অতি জরুরি। কিন্তু সেটি নেই। জনবল, বিশেষ করে চিকিৎসক না থাকায় পাঁচটি বিভাগ চালুই করা সম্ভব হয়নি। আবার চালু পাঁচটি বিভাগের জন্য চিকিৎসকের পদ আছে ৪২টি। সেখানে আছেন মাত্র ২৭ জন। এক কথায় জোড়াতালি দিয়ে চলতে হচ্ছে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল : ১৫ অক্টোবর সরেজমিনে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা যায়, ‘ডিজিটাল এক্সরে মেশিনের প্লেট নেই’ অজুহাতে রোগীদের ডিজিটাল এক্সরে করাতে নির্দিষ্ট ব্যক্তিমালিকানার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হচ্ছে। সাধারণ রোগীদের অভিযোগ, এক্সরে, প্যাথলজি বিভাগের টেকনিশিয়ান ও বহির্বিভাগের কিছু চিকিৎসক হাসপাতালের সামনের পাঁচটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত। তারা নানা অজুহাত ও টেকনিক্যাল সমস্যা সৃষ্টি করে রোগীদের বাইরে থেকে প্যাথলজি পরীক্ষা করিয়ে আনতে বাধ্য করেন। জানা যায়, ২৫০ শয্যার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিকে ৫০০ শয্যায় ঘোষণা দেওয়া হয় ২০০৮ সালে। এখানে কর্মরত ৩৮২ জন জনবলের সঙ্গে আরও এক হাজার ২৬৮টি পদ সৃষ্টির সর্বশেষ প্রস্তাবটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন আটকে আছে। এ বিষয়ে চিঠি চালাচালিতেই কেটে গেছে সাত বছর। হাসপাতালের কার্ডিওলোজি, আইসিইউ, মেডিসিন ও গাইনি বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি, শিশু নেফ্রোলজি, ডেন্টাল, হেপাটোলজি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রারের পদও শূন্য।

খুলনা জেনারেল হাসপাতাল : ১৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালটি মেডিসিন, প্যাথলজি, রেডিওলজি বিভাগের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হলেও জনসাধারণের যেন আস্থা নেই এর প্রতি। সার্জারি, অর্থোপেডিক, চক্ষু, মেডিসিন ও গাইনি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট এবং সহকারী রেজিস্ট্রারের পদ দীর্ঘদিন শূন্য। এ পদগুলো পূরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও অনেকটা গা-ছাড়া ভাব। হাসপাতালটি ১৫০ শয্যার হলেও চলছে ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে। এখানে রেডিওলজিস্ট না থাকায় এক্সরে রিপোর্ট করছেন টেকনিশিয়ান। সার্জন ছাড়া জরুরি বিভাগে ছুরি-কাঁচি চালান ওয়ার্ড বয়, সুইপাররা। চিকিৎসক না থাকায় মাঝেমধ্যেই বন্ধ থাকে সার্জারি বিভাগ। একইভাবে ‘ডিজিটাল এক্সরে মেশিন’ই নেই এই হাসপাতালে। এখানে চারটি এক্সরে মেশিন থাকলেও ২০১০ সাল থেকে দুটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। যে এক্সরে মেশিন দিয়ে ১৯৩৫ সালে হাসপাতালটির যাত্রা হয়েছিল, সেটিরও কোনো হদিস নেই।

খুলনার সিভিল সার্জন ডা. মো. ইয়াছিন আলী সরদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোয় বর্তমানে চিকিৎসা-সংক্রান্ত যেসব সুযোগ-সুবিধা বরাদ্দ আছে এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করলে কোনো অভিযোগ থাকত না। কিন্তু আমরা যারা চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ষুক্ত আছি, তাদের এ সেবা দেওয়ার মানসিকতায় সমস্যা রয়েছে। এর পরিবর্তন আগে প্রয়োজন। নইলে শত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হাসপাতাল ভরে ফেললেও সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে না।

 

সর্বশেষ খবর