শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ঝুঁকিতে স্থানীয়রা, ধ্বংস হচ্ছে জীব কোষ

চট্টগ্রামে ৩১ বছরের পুরনো বিষাক্ত ডিডিটি

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে ৩১ বছরের পুরনো বিষাক্ত ডিডিটি

পৃথিবীর কোনো দেশেই অস্তিত্ব নেই ডাইক্লোরো ডাইফিনাইল ট্রাইক্লোরোইথেন (ডিডিটি) পাউডারের। কিন্তু চট্টগ্রামের চারটি গুদামে ৩১ বছর ধরে পড়ে আছে এসব ক্ষতিকারক পাউডার। এতে চরম ঝুঁকিতে আছে স্থানীয় মানুষ। ধ্বংস হচ্ছে জীবকোষ। আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা আছে ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য রোগে। আর এ কারণেই জাতিসংঘ বিশেষ ব্যবস্থায় আগামী জুনে এগুলো ধ্বংসের উদ্যোগ নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের কেন্দ্রীয় ওষুধাগার (ঢাকা) নিয়ন্ত্রিত সহকারী পরিচালক (স্বাস্থ্য) পোর্ট ক্লিয়ারেন্সের (চট্টগ্রাম) কার্যালয়ের ৪, ১১, ১২ ও ১৩ নং গুদামে আছে এসব বিষাক্ত ডিডিটি পাউডার। ডিডিটির বস্তাগুলো ফেটে পাউডার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ভাঙা দরজা-জানালা-ভেন্টিলেটরের ফাঁকফোকর দিয়ে ডিডিটি পাউডার মেশা বাতাস বের হচ্ছে। সহকারী পরিচালক (স্বাস্থ্য) পোর্ট ক্লিয়ারেন্স কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে দেশে ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রণে ‘পাবলিক হেলথ প্রোগ্রাম’ প্রকল্পের আওতায় মশা নিধনের জন্য ৫০০ টন ডিডিটি পাউডার আনা হয়। ৩ কোটি ৫৯ লাখ ১৪ হাজার ৬৪০ টাকায় আনা ওই পাউডার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ঢাকা টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষায় নিম্নমানের বলে প্রমাণিত হয়। অত্যন্ত ক্ষতিকারক এসব পাউডার বাংলাদেশে তো নয়ই, উপমহাদেশের কোনো দেশেই ধ্বংস করার ব্যবস্থা নেই। কেবল পৃথিবীর চারটি দেশেই ধ্বংস করা হয় এসব পাউডার। সহকারী স্বাস্থ্য পরিচালক (পোর্ট ক্লিয়ারেন্স) ডা. সফিউল আলম চৌধুরী বলেন, আগামী ডিসেম্বরে পাউডারগুলো ধ্বংসের জন্য জাতিসংঘের ‘গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল ফান্ড’ থেকে বাজেট আসবে। আগামী বছরের ১৬ জুনের মধ্যে বিশেষ জাহাজে করে জার্মানিতে নিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা হবে। তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালেই সারা বিশ্বে এ পাউডার উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. সৈয়দ নুরুল আলম বলেন, ১৯৮৪ সালে আমদানি করা এসব ডিডিটি পাউডার জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। সরকার ইতিমধ্যে এফএওকে অনুরোধ করেছে পাউডার ধ্বংস করার জন্য। জানা যায়, ১৯৮৫ সালের ১৯ মার্চ ওই ডিডিটির নমুনা পরীক্ষার জন্য জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পাঠানো হয়। তারা পাউডার নিম্নমানের রিপোর্ট দেওয়ায় সরকার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে (মেসার্স এক্সচেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড) ১০০০ টন ডিডিটি পাউডার প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আইসিসি কোর্টে সালিশি মামলা দায়ের করলে তা বাংলাদেশ সরকারের বিপক্ষে যায়। সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল মামলা দায়ের করে। বর্তমানে এটি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। পোর্ট ক্লিয়ারেন্স কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থায়নে এই পাউডার ধ্বংসের উদ্যোগ নেয় সরকার। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় আট মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে ৬২ কোটি টাকা)। ২০১৪ সালের ২ মার্চ জেনেভা থেকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিনিধি মার্ক ডেভিস, সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি মাইক রবসন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যালেরিয়া প্রোগ্রাম কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম, পরিবেশ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সরওয়ার ইমতিয়াজ হাশমি, চট্টগ্রাম বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আলাউদ্দিন  মজুমদারসহ বিভিন্ন দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চট্টগ্রামে জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে এফএও’র অর্থায়নে দ্রুত পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি ওই পাউডার দেশের বাইরে নিরাপদে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত হয়।

তা ছাড়া ২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর এফএও’র প্রতিনিধি হিসেবে মার্ক ডেভিস পরিদর্শনে এসে ‘ডিডিটিগুলো পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন’। গত বছরের ৮ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. শাহনেওয়াজ (বর্তমানে অবসরে) গুদাম পরিদর্শন করে জানান, ‘গুদামগুলোর যে স্থানে ডিডিটি পাউডার রাখা, ভবনের সেই অংশ যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভবনের নিচতলায় অফিস করেন।’ ২০১৪ সালের ৫ জুলাই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সৈয়দ নুরুল আলমের নেতৃত্বে একটি টিম গুদাম পরিদর্শন করে। এ সময় তারা চারটি গুদাম থেকে ১০ গ্রাম করে ডিডিটি পাউডারের ৫০টি নমুনা সংগ্রহ করে। নমুনায় দুটি গুদামে সর্বোচ্চ ৮১ ও ৭৫ ভাগ ও নিচের গুদামে ৪৫ ভাগ রাসায়নিক উপাদানের অস্তিত্ব মিলে বলে প্রতিবেদন দেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক বেণু কুমার দে বলেন, এই রাসায়নিক জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এসব পাউডার যে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। ফলে সরকার ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামে অবস্থিত ডিডিটি উৎপাদন কারখানাটি বন্ধ করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, ওই সময় থেকে সরকার ডিডিটি আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয়।

 

সর্বশেষ খবর