সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ধূমপান ও মাদকে বেপরোয়া নারী

জিন্নাতুন নূর

ধূমপান ও মাদকে বেপরোয়া নারী

রাজধানীর ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোডের একটি রুফটপ রেস্টুরেন্টে খোলা আকাশের নিচে খাবারের স্বাদ নিতে সন্ধ্যার পর থেকেই তরুণ-তরুণীদের ভিড় জমে। কিন্তু শুধুই কি খাবার নিতে সেই রেস্টুরেন্টে এত ভিড়? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেই রেস্টুরেন্টে খোলা জায়গায় প্রতিদিন আশপাশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীসহ আরও উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়ে খাবার খেতে আসেন ঠিকই, কিন্তু এর সঙ্গে চলে লাগাতার ধূমপান। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেয়েরাও একের পর এক সিগারেট পুড়িয়ে ধোঁয়ায় উড়িয়ে দেন। যত না খাবার খাওয়া হয় তার চেয়ে বেশি চলে ধূমপান। ঢাকার  রুফটপ রেস্টুরেন্টগুলোতে এখন কমবেশি বিভিন্ন বয়সী নারীদের ধূমপান করার এই দৃশ্য চোখে পড়ে। আগে আড়ালে ধূমপান করলেও মেয়েরা এখন আর রাখডাক করছেন না। তবে শুধু ধূমপান নয়, ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে নারীদের সিসা গ্রহণ করার দৃশ্যও এখন কমবেশি চোখে পড়ছে। এর পাশাপাশি ডিজে পার্টিগুলোতে চলছে আশঙ্কাজনকহারে ইয়াবা সেবন।

কম হলেও কিছু মাদকাসক্ত নারী ফেনসিডিলও খাচ্ছেন। আর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীসহ নিæবিত্ত নারীদের অনেকেই গাঁজা সেবন করছেন। মাদক চিকিৎসায় জড়িত ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। অর্থাৎ মাদক গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের মধ্যে এখন অনেকটা বেপরোয়া ভাব তৈরি হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু রেস্টুরেন্টই নয়, তরুণী, নারী ও টিনএজ মেয়েরা এখন প্রকাশ্যেই শহরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, বেসরকারি অফিস, ডিজে পার্টি এবং ওপেন এয়ার কনসার্ট বা সংগীত উৎসবসহ নানা স্থানে ধূমপান করছেন। এই ধূমপায়ীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই বয়সে টিনএজার ও তরুণী। নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকায় তামাকজাত পণ্য বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বললে তারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগের চেয়ে এখন মেয়েদের ধূমপানে আসক্তি কয়েকগুণ বেড়েছে। তারা আগে সিগারেট কিনতে নিজেদের ছেলে বন্ধু, গৃহকর্মী, ভাই বা অন্য কারও সাহায্য নিলেও এখন নিজেরাই সরাসরি বিক্রেতার কাছ থেকে সিগারেট কিনছেন। সম্প্রতি গুলশান-২ নম্বর মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, সিএনজি অটোরিকশা থেকে নেমে একজন নারী ক্রেতাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ‘তিনি কত দিন ধরে এবং কেন ধূমপান করছেন’ তা জানতে চাইলে নিজের পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে সেই নারী বলেন, তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন। ঢাকায় তার এক বান্ধবীর সঙ্গে একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়া থাকছেন। তিনি একটি ছেলেকে পছন্দ করতেন, কিন্তু তার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় মানসিকভাবে বিষন্ন হয়ে পড়েন। বিষণœতা কাটাতে ধূমপান শুরু করেন। এখন ধূমপানে তার আসক্তি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় য²া নিরোধ সমিতি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশে মোট নারীর ২ কোটিরও কিছু বেশি তামাক সেবন ও ধূমপানে আসক্ত। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪৩.৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর ওপর করা এক জরিপ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ভাগ মেয়ে শিক্ষার্থীই ধূমপায়ী। মূলত আর্থিকভাবে সচ্ছল ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মেয়েরা বেশি ধূমপানে  আসক্ত। এর মধ্যে উল্লেখ সংখ্যক মেয়ে শিক্ষার্থী, শতকরা ৬৬ ভাগই চারুকলা অনুষদের। এ ছাড়া রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিভিন্ন আড্ডায় মেয়ে, তরুণী ও নারীদের প্রায়ই প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখা যায়। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এক অনুষ্ঠানে জানান, দেশে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ দশমিক সাত শতাংশ নারী তামাক ব্যবহারের কারণে মারা যান। এদিকে ওয়াকিবহাল সূত্রগুলোর ভাষ্য, শুধু ধূমপান নয়, এর সঙ্গে উল্লেখ সংখ্যক নারী মাদকের নীল জালে আটকা পড়েছেন। তারা শুধু যে মাদক গ্রহণ করছেন তা নয়, মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছেন। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত ২০১২ সালের এক জরিপে জানা যায়, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। এ ছাড়া জাতিসংঘের এক জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ৬৫ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে ১৩ লাখের বেশি নারী কোনো না কোনো মাদক সেবন করছেন। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবে, দেশের ৪০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা চার লাখ। তবে বর্তমানে যে নারীরা ইয়াবা গ্রহণ করছেন তাদের সবাই যে মাদকাসক্ত তা নয়। পুরোপুরি মাদকাসক্ত হতে তাদের আরও ৫ থেকে ৭ বছর লাগবে। সে সময় তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিনএজ মেয়ে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী ছাড়াও মাদকাসক্তের তালিকায় আছে গৃহবধূ ও চাকরিজীবী নারী। নারী মাদকাসক্তদের মধ্যে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও ইংরেজি মাধ্যমের মেয়ে শিক্ষার্থী। মাদকাসক্তদের চিকিৎসকরা জানান, বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের মধ্যে নারী, তরুণী ও কিশোরীরা সিগারেট, ইয়াবা প্যাথিড্রিন, হোরোইন, ফেনসিডিল ও গাঁজা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি তারা ইয়াবা গ্রহণ করছেন। মাদক বিশেষজ্ঞরা জানান, মূলত স্কুল ও কলেজগামীদের টার্গেট করে ইয়াবা তৈরি করা হয়। ইয়াবা আকৃতিতে ছোট, এর গন্ধ স্ট্রবেরির মতো, দেখতেও রঙিন এবং আকর্ষণীয়। ফলে কিশোরীরা সহজেই ইয়াবায় আসক্ত হন। এ ছাড়া মাঝ বয়সী নারীরা সুই দিয়ে প্যাথিড্রিন ওষুধ নেওয়ার সময় অনেকেই প্যাথিড্রিনে আসক্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ ফেনসিডিলও খাচ্ছেন। তবে এ সংখ্যা বেশি নয়। চিকিৎসকরা বলছেন, আমাদের কাছে যদি ১০% পুরুষ চিকিৎসা নিতে আসেন তবে নারী মাদকাসক্তের হার ১%।

উত্তরার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র লাইট হাউসের কনসালটেন্ট ডা. জসিম চৌধুরী বলেন, সাধারণত মাদকাসক্ত নারীদের অরুচি, অনিদ্রা, শুকিয়ে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, মানসিক ভারসাম্যহীনতার মতো সমস্যা তৈরি হয়। এ ছাড়া গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে মাদক গ্রহণের ফলে মা ও গর্ভের সন্তান উভয়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়। গর্ভের সন্তান অপুষ্ট হওয়া, কিছু ক্ষেত্রে গর্ভেই সন্তানের মৃত্যু হতে পারে। কোনো কোনো সূত্র মতে, নারীরা বিভিন্ন কারণে মাদক গ্রহণ করেন। শরীরের আকার বা ফিগার ঠিক রাখা, রাত জেগে অনলাইন ব্যবহার করা ও মোবাইলে কথা বলা, পারিবারিক অশান্তি, বিবাহ বা সম্পর্ক বিচ্ছেদ ইত্যাদি কারণে তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। মাদকদ্রব্যের সহজপ্রাপ্তিও নারীদের আসক্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ) মো. আবুল হোসেন বলেন, দেশে কত সংখ্যক নারী মাদক গ্রহণ করছেন সরকারিভাবে এ বিষয়ে কোনো জরিপ নেই। এ বিষয়ে জরিপ করা হলে বিষয়টি আরও গুরুত্ব পাবে।

 

সর্বশেষ খবর