সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দুর্নীতি-অনিয়মে হাবুডুবু খাচ্ছে ফরিদপুর সদর হাসপাতাল

কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর

দুর্নীতি-অনিয়মে হাবুডুবু খাচ্ছে

ফরিদপুর সদর হাসপাতাল

নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে ফরিদপুর সদর হাসপাতাল। দিনের পর দিন এমন অবস্থা চলতে থাকলেও দেখার যেন কেউ নেই। সরকার পরিচালিত এ হাসপাতালটিতে রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কথা থাকলেও টাকা ছাড়া সেবা মেলে না। ‘দালাল’ ও ‘সিন্ডিকেট’ চক্র জিম্মি করে রেখেছে পুরো ব্যবস্থাপনাকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফরিদপুর স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ফরিদপুর সদর হাসপাতালে সিন্ডিকেট চক্রটি বেশ প্রভাবশালী। চক্রটির ক্ষমতা এতই শক্তিশালী যে তারা সিভিল সার্জন অফিসের নির্দেশও মানে না। এই কর্মকর্তা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘হাসপাতালটিতে সিন্ডিকেট চক্রের কারণে এমন অবস্থা হয়েছে যেন কুকুরে লেজ নয়, লেজই নাড়াচ্ছে কুকুরকে।’ ফরিদপুরবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১৯১৭ সালে ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী এলাকায় এ হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়। প্রথম দিকে ৫০ বেড থাকলেও বর্তমানে বেডের সংখ্যা একশ। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালটিতে নানা ধরনের অনিয়ম আর দুর্নীতি চলে আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চিকিৎসাসেবা নেই বললেই চলে। হাসপাতালটিতে বেশ কয়েকটি বিভাগ নামেমাত্র থাকলেও সেখানে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না। দন্ত বিভাগে গিয়ে কেউ চিকিৎসা পেয়েছেন এমন নজির সাম্প্রতিক সময়ে নেই। রোগীদের অভিযোগ, এ বিভাগে গেলে নানা অজুহাতে তাদের সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হয়। সুকৌশলে এ বিভাগের ডাক্তারের প্রাইভেট ক্লিনিকে দেখা করার কথা বলা হয়। বিভিন্ন সূত্রে আরও নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাসপাতালটিতে অত্যাধুনিক একটি ‘আলট্রাসনোগ্রাম’ মেশিন থাকলেও সেটি কার্যত অকেজো করে রাখা হয়েছে। ফলে রোগীদের বাইরে থেকে আলট্রাসনো করতে হচ্ছে। ফরিদপুরের সবচেয়ে ভালো এক্স-রে মেশিনটি এ হাসপাতালে থাকলেও সেটি ‘নষ্ট’ কিংবা ‘এক্স-রে পেপার নেই’ বলা হয়। দালালদের মাধ্যমে বাইরে থেকে এক্স-রে করতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালে যে কয়টি বিভাগ রয়েছে তার মধ্যে এক্স-রে বিভাগটি বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। এ বিভাগে শাহজাহান নামের একজন নিয়োগপ্রাপ্ত থাকলেও বেশির ভাগ সময় তিনি অফিসে থাকেন না। সারা মাসই বাইরের এক ব্যক্তি এ বিভাগের সব কাজ করেন। তাকে টাকা না দিলে কোনো কাজ হয় না। এভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ছাড়া চাকরি করার নজির সৃষ্টি করেছে এ হাসপাতাল। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগের পর অভিযোগ জমা হলেও সে অভিযোগের কোনো ফল মেলেনি। অভিযোগ অনুযায়ী, সার্র্জিক্যাল বিভাগের ওয়ার্ড বয় লতিফকে ‘স্যার’ না বললে তিনি রোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। জনৈক রোগী অভিযোগ করে বলেন, ‘লতিফকে ভাই বলাতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাকে কেন স্যার বলা হয়নি এ জন্য তিনি রোগী ও তার স্বজনদের ধমকান।’ হাসপাতালটিতে সিন্ডিকেট চক্র এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের কথার বাইরে কোনো কাজ হয় না। যাবতীয় সাপ্লাইয়ের কাজ তারাই করে থাকেন। সম্প্রতি চাদর ধোলাইয়ের কাজ নিয়ে বড় ধরনের ঘাপলা করে এ চক্রটি। প্রতিদিন তারা ৭০০ চাদর ধোলাই করে বলে বিল করে। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে একটি তদন্ত টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তাতে দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। হাসপাতালের খাবার সাপ্লাই নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। প্রতিদিন রোগীদের যে খাবার দেওয়া হয় তা একেবারেই নিম্নমানের। প্রতিদিন খাবার তালিকায় যা থাকার কথা তা দেওয়া হচ্ছে না। রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতাল থেকে যে খাবার পরিবেশন করা হয় তা মুখে দেওয়া যায় না। বেশির ভাগ রোগীই বাইরে অথবা বাড়ি থেকে খাবার এনে খান। এ ছাড়া হাসপাতাল থেকে রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয় না। রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতাল থেকে ওষুধ দেওয়া তো দূরে থাক গজ-ব্যান্ডেজ আর তুলার মতো জিনিসও বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। তাদের আরও অভিযোগ, অপারেশন করতে হলে ওষুধের লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে অপ্রয়োজনীয় ওষুধও লিখে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ওইসব অব্যবহৃত ওষুধ বাইরের ফার্মেসিতে বিক্রি করা হয়। হাসপাতালের বাথরুমগুলোর অবস্থা যাচ্ছেতাই। বেশির ভাগ ওয়ার্ডের বেডও ভাঙাচোরা। কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে এগুলো চালানো হচ্ছে। বাতাসের জন্য পর‌্যাপ্ত ফ্যান নেই। নেই পর‌্যাপ্ত লাইট। ফলে রাতের বেলা একেবারে ভুতুরে পরিবেশ তৈরি হয় হাসপাতালে। চারটি কেবিন থাকলেও সেগুলো নামেমাত্র। কোনো সুযোগ-সুবিধাই নেই সেখানে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাসপাতালের ‘সিন্ডিকেট’ চক্র এসব ‘কেবিন’ নিজেদের দখলেই রাখেন। এ চক্রকে ম্যানেজ করলেই মেলে কেবিন। হাসপাতালে সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। একটি মাত্র টিউবওয়েল থাকলেও সেই পানি খাবার অযোগ্য। ফলে বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনদের বাইরে থেকে পানি আনতে হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি ও ওষুধ কেনা হয়। এই কেনা নিয়ে রয়েছে বড় রকমের দুর্নীতি। টেন্ডারের শর্তাবলি অনুযায়ী যে ওষুধ সরবরাহ করার কথা, তা মেলে না। আবার হাসপাতালটিতে ডাক্তারের সংকট তেমন একটা না থাকলেও দিনের বেশির ভাগ সময় ডাক্তারদের খুঁজে পাওয়া যায় না। বেলা ১টার পর একজন ডাক্তারকেও পাওয়া যায় না। অথচ সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত হাসপাতালে ডাক্তার থাকার কথা। জানা যায়, ডাক্তারদের প্রায় সবাই বিভিন্ন ক্লিনিকে বসেন। ফলে তাদের দিনের বেশির ভাগ সময়ই পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। হাসপাতালে ডাক্তার ও কর্মচারীদের জন্য একটি ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন রয়েছে যেখানে তারা কখন আসেন, কখন বেরিয়ে যান, এমনটি রেকর্ড হয়। কিন্তু বাস্তবে সেই মেশিনটি ইচ্ছাকৃতভাবে বিকল করে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের প্রধান সহকারী জাকির হোসেন জানান, চতুর্থ শ্রেণির অফিস সহায়ক, পরিছন্নতা কর্মীর বেশ কিছু পদ খালি রয়েছে। এগুলো পূরণ হলে যে সমস্যাগুলো রয়েছে তার সমাধান হবে। সিভিল সার্জন ডা. অসিত রঞ্জন দাস বলেন, ‘আগের তুলনায় হাসপাতালের অনিয়ম কমেছে।’ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যোগদানের আগে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ছিল। এখন সেগুলো নেই। হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো দরকার। এটিকে ৩০০ বেডে উন্নীত করা হলে ভালো হয়।’

 

সর্বশেষ খবর