মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ক্লিনিক-দালালদের কাছে জিম্মি ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতাল

মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ক্লিনিক-দালালদের কাছে জিম্মি ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতাল

চারদিকে ময়লার স্তূপ, নোংরা, দুর্গন্ধে নাক-মুখ বুজে চলাচল করতে হয়। দালালদের দৌরাত্ম্য, চিকিৎসকরা প্রাইভেট চিকিৎসা নিয়ে থাকেন ব্যস্ত। জরুরি বিভাগের অব্যবস্থাপনা, খাবার সরবরাহ এবং ওষুধ বিতরণে অনিয়ম। রয়েছেন ৫৫ চিকিৎসকের স্থলে ৪৫ জন, ১৪১ জন নার্সের স্থলে ৫৫ জন, প্রেষণে ১৫ জন। চারতলা বিশিষ্ট হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। এতে দুর্ভোগের শিকার হন দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা। এটি হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালের চিত্র। ২০১১ সালে হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়।

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৮টায় চিকিৎসক আসার কথা। রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসকের দেখা পান না। টিকিট কাউন্টার খোলা হয় ৯টা থেকে সাড়ে ৯টায়। সকাল ৯টায় চিকিৎসকরা খাতা স্বাক্ষরের নামে তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে আড্ডায় লিপ্ত হন। অনেক চিকিৎসক লাইনে রোগী দাঁড় করিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে চলে যান। অধিকাংশ চিকিৎসক ক্লিনিক ব্যবসায় সরাসরি জড়িত। কারও আছে ৩-৪টি  ক্লিনিকের মালিকানা। রোগীরা জানান, অর্থোপেডিকস সার্জন শ্যামল রঞ্জন দেবনাথ তার ক্লিনিকে যেতে ভিজিটিং কার্ড দেন। ৬০ টাকা মূল্যের ট্রায়লন ও ২৫০ টাকা মূল্যের ডেপোমেড্রল ইনজেকশন পুশ করতে রোগীদের থেকে হাতিয়ে নেন ৩ হাজার টাকা। চিকিৎসক ফায়েজুর রহমান ফয়েজ স্বাচিপ নেতা পরিচয়ে চিকিৎসকদের নেতৃত্ব আর ক্লিনিক নিয়ে দিন পার করেন। সহকারী শিশু কনসালটেন্ট ক্লিনিকে গিয়ে প্রাইভেটে প্র্যাকটিস করেন অফিস সময়ে। স্বাচিপের প্রভাবশালী এক নেতা নিজস্ব ক্লিনিকে বসে সকাল থেকেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। জরুরি ফাইলপত্র ক্লিনিকে নিয়ে সই করেন। রোগের আতঙ্ক দেখিয়ে রোগীকে ক্লিনিকে ভর্তি করান শিশু কনসালটেন্ট মোহাম্মদ মনির হোসেন। চিকিৎসক তোফায়েল হক ক্লিনিক নিয়ে থাকেন ব্যস্ত। রাতের বেলা রোগীদের রান্না করা খাবারসহ বরাদ্দকৃত শুকনো খাবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। ফিজিওথেরাপিস্ট তনয় দাস এবং ওয়ার্ড মাস্টাররা ক্লিনিকের এক্সরে দিয়ে ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে। ভুয়া সার্টিফিকেটের জন্য ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালে ২০ মহিলা দালালসহ অন্তত দেড়শ দালাল তৎপর। যে চিকিৎসকের কক্ষে রোগী বেশি সেখানেই দালালরা রোগীর সিরিয়াল করেন। তারা কৌশলে রোগীদের নিজেদের পছন্দের ক্লিনিকে পাঠান। কোনো কোনো চিকিৎসক প্যাথলজি পরীক্ষা করার জন্য নির্দিষ্ট ক্লিনিকের কার্ড দেন। প্যাথলজি বিভাগে কয়েকজন রোগীর রসিদের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ রোগীর রক্ত পরীক্ষা করা হয় বলে জানা যায়। পরে ওই টাকা সিন্ডিকেটের লোকজন ভাগ করে নেয়। জরুরি বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা রোগীর সেলাই, ব্যান্ডেজসহ বিভিন্ন কাজের জন্য ১০০-৫০০ টাকা নিয়ে থাকেন বলে একাধিক রোগী জানান। কর্মরত নার্সরা ক্যানোলা, ইনজেকশন, সেলাইন পুশের জন্য ৫০-২০০ টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী জানান, আরএমওর আস্থাভাজনরাই জরুরি বিভাগে কাজ করেন। তারা বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য তার ক্লিনিকেই পাঠায়। দুপুর ২টার পর ইমারজেন্সিতে মেডিকেল অফিসার ছাড়া কনসালটেন্ট থাকেন না। গাইনি, সার্জিকেল এবং অর্থোপেডিকস রোগী এলে নির্দিষ্ট ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য ক্লিনিকের কার্ড দেওয়া হয়। হাসপাতালের অফিস সহকারী ইনামুল হক এবং আনোয়ার হোসেন জুনিয়র মেকানিক্যাল পদে কর্মরত হয়েও স্বাচিপ ও বিএমএ নেতাদের বদৌলতে ওয়ার্ড মাস্টারের দায়িত্বে পালন করছেন। দৈনিক ভিত্তিতে কর্মচারীদের উপস্থিতি দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। হাসপাতালের রন্ধনশালা দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইনামুল হককে। আলোচনা আছে, তাদের দুজনেরই ৪টি ও ২টি ক্লিনিকে মালিকানা শেয়ার আছে। হাসপাতালের এক শ্রেণির কর্মচারী ও চিকিৎসক ওষুধের স্লিপ দিয়ে কাউন্টার থেকে দামি দামি ওষুধ উত্তোলন করেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের দেওয়া হয় সাধারণ ওষুধ। এক কর্মচারী জানান, অপারেশন থিয়েটার ইনচার্জ, ওয়ার্ড ইনচার্জ, জরুরি বিভাগ ইনচার্জ, স্টোর কিপার, হাসপাতালের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ ওষুধ কুমিল্লা এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে টিকিট বিক্রি হয় ২২ থেকে ২৫০০। খাতা-কলমে দেখানো হয় ১৩ থেকে ১৪০০ টিকিট। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ডায়রিয়া ওয়ার্ড, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি ওয়ার্ড, অর্থোপেডিকস ও কার্ডিওলজি ওয়ার্ড, সার্জারি ওয়ার্ড, শিশু ওয়ার্ড, সিঁড়ি, প্রতিটি ওয়ার্ডের মেঝেসহ সব জায়গাই দুর্গন্ধ। শৌচাগারের পানি ওয়ার্ডের মেঝেতে চলে আসে। বেশির ভাগ শৌচাগার ব্যবহারের অনুপযোগী। অনেক রোগী ওয়ার্ডের দুর্গন্ধের জন্য বারান্দায় আশ্রয় নেন। হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার ইনামুল হক জানান, চেষ্টা করা হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ও আরএমও ডা. রানা নুরুস শামস বলেন, সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের। অনিয়ম দূর করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

 

সর্বশেষ খবর