বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শনাক্তকরণের অভাবে যক্ষা বাড়ছে দ্বিগুণ

বক্ষব্যাধি হাসপাতালে হিমশিম অবস্থা

লাকমিনা জেসমিন সোমা

শনাক্তকরণের অভাবে দেশে বাড়ছে যক্ষার প্রকোপ। মূলত কফ পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর ভিত্তিতে এই রোগের প্রকোপ নির্ণয়ের চেষ্টা করায় এর বাস্তব অবস্থা বোঝা সম্ভব হয়নি। ফলে শনাক্ত না হওয়া বা যক্ষার জীবাণু নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এসব ব্যক্তিরাই আরও ভয়ঙ্কর মাত্রায় ছড়িয়েছেন এই রোগ। এমনকি এখনো প্রতিদিন তারা নিজেদের অজান্তেই ছড়াচ্ছেন যক্ষার জীবাণু। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে পুনরায় দেশে যক্ষার প্রকোপ নির্ণয় করতে গিয়ে এই ভয়ঙ্কর অবস্থা টের পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। যক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ যাবৎ যক্ষা নিয়ে যেসব অনুমানভিত্তিক গবেষণা করা হয়েছে তার চেয়ে বাংলাদেশে যক্ষায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা  দ্বিগুণ। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, আগের তুলনায় দ্বিগুণ হারে বেড়েছে রোগীর সংখ্যা। এমনকি পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। এ প্রসঙ্গে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রাশেদুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একজন যক্ষা রোগী কমপক্ষে ২০-৩০ জনের দেহে যক্ষা ছড়ান। আগে আমরা অনুমানের ভিত্তিতে গবেষণা করে যেসব তথ্য পেয়েছি তা বাস্তবতার তুলনায় অতি নগণ্য। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ‘জিন এক্সপার্ট’ পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা যে গবেষণাটি করছি তার ফলাফলে যক্ষার প্রকোপ হয়তো আরও দ্বিগুণ হারে ওঠে আসতে পারে। আগামী বছরের মার্চ মাস নাগাদ এই গবেষণা সম্পন্ন হতে পারে বলে জানান তিনি। তবে তার মতে, যক্ষার প্রকোপ বাড়ছে এমনটি নয়, বরং এত দিন শনাক্তকরণ হয়নি বলেই মানুষ এই ভয়াবহতা টের পায়নি। মঙ্গলবার সরেজমিন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশ ব্যক্তিই যক্ষা রোগী। একইভাবে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোও যক্ষা রোগীতে পরিপূর্ণ। সেখানে জায়গা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই। চিকিৎসকরাও স্থান সংকুলান না হওয়ায় মারাত্মকভাবে আক্রান্তদের ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক ও আর পি ডা. বরকত উল্লাহ্ বলেন, যক্ষা রোগীদের চিকিৎসার জন্য মাত্র ৬৭০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতাল মোটেও যথেষ্ট নয়। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী আসছেন বক্ষব্যাধির চিকিৎসা নিতে। ভর্তি হতে হচ্ছে অন্তত ২০-৩০ জনকে। এদের অধিকাংশই যক্ষা রোগী। তবে পর্যাপ্ত বেড না থাকার কারণে ৩-৪ জনের বেশি যক্ষা রোগীকে ভর্তি করতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাদের ঢাকার অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার সুপারিশ করে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অপর একজন চিকিৎসক জানান, এক্সরে যন্ত্র না থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে যক্ষা শনাক্তকরণ সম্ভব হচ্ছে না। কেউ কেউ বলছেন, মাঠপর্যায়ে যক্ষা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নজরদারিও কম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বের যক্ষাপ্রবণ ২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। প্রতি বছর সাড়ে তিন লাখ মানুষ নতুন করে টিবি রোগে এবং চার হাজার ৭০০ জন এমডিআর-টিবি (ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষার জীবাণুতে) রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। চলতি বছর মে মাসে ইউএসএইড-এর সহযোগিতায় করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক টিবি রোগী এবং তিন-চতুর্থাংশ এমডিআর-টিবি রোগী অশনাক্ত থেকে যাচ্ছেন। ফলে যক্ষার জীবাণু বহনকারী এই বিপুল পরিমাণ মানুষ প্রতিনিয়ত অন্যের দেহে যক্ষা ছড়াচ্ছে। গত মাসে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) নির্ধারণের সময় ২০১৫ সালের মধ্যে যক্ষায় আক্রান্ত, যক্ষার প্রকোপ ও যক্ষায় মৃত্যু কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, বাংলাদেশ তা অর্জন করতে পারেনি। কেননা, লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার সময় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে নতুন রোগী শনাক্তের হার (প্রতি লাখে) বাড়িয়ে ১২০ করা হবে। বর্তমানে সেই হার ৫৩। ১৯৯০ সালে যক্ষার প্রকোপের হার ছিল ৫০৪ (প্রতি লাখে)। বলা হয়েছিল, এই হার কমিয়ে ২৫০ করা হবে। কিন্তু বর্তমানে তা ৪০২। অন্যদিকে যক্ষায় মৃত্যুর হারও কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। বছরে প্রতি লাখে ৮০ জনের মৃত্যু হতো যক্ষায়। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০। বর্তমানে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে যক্ষায় ৫১ জনের মৃত্যু হচ্ছে। জানা গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধায়নে গ্লোবাল ফান্ডিং এবং ইউএসএইড-এর সহযোগিতায় প্রায় ৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আওতায় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের এনটিআরএল ল্যাবরেটরিতে নতুন করে যক্ষার প্রকোপ নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে সরাসরি যক্ষা রোগ নির্ণয়ক বিভিন্ন স্যাম্পল (কফ, মাইক্রোসকপি, জিন এক্সপার্ট, টিবি কালচার) সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এই গবেষক দলের একটি দায়িত্বপ্রাপ্ত সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ ভাগ স্যাম্পল পরীক্ষা শেষ হয়েছে, যার একটি বড় অংশই টিবি পজেটিভ হিসেবে গণ্য হয়েছে। এদিকে গত ২৮ অক্টোবর যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি প্রভাবশালী জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট বলছে, বাংলাদেশের বক্ষব্যাধি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ৯ শতাংশের শরীরে যক্ষার জীবাণু শনাক্ত হচ্ছে। অন্য রোগের চিকিৎসায় হাসপাতালে ভর্তি হতে এসে তারা টিবি আক্রান্তের বিষয়টি জানতে পারছেন। অর্থাৎ নিজেদের অজান্তেই এই জীবাণু বহনকারীরা নিজেরা যক্ষায় ভুগছেন এবং অন্যদের শরীরে ছড়াচ্ছে। যক্ষা নিয়ে প্রকাশিত চারটি প্রবন্ধের দ্বিতীয়টিতে এই তথ্য দেয় সাময়িকীটি। যক্ষা বিশেষজ্ঞ রাশেদুল হাসান বলেন, কেবল তিন সপ্তাহের বেশি কাশি হওয়া নয়- ওজন কমে যাওয়া, ঘুম না হওয়া, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা ও ক্ষুধামন্দা কিংবা কাশির সঙ্গে রক্ত বের হওয়া- এসবের যে কোনো একটি হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সর্বশেষ খবর