মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মানহীন পণ্যের ছড়াছড়ি দেশজুড়ে

জিন্নাতুন নূর

মানহীন পণ্যের ছড়াছড়ি দেশজুড়ে

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মানহীন ও ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি। এসব পণ্য দাম দিয়ে কিনে ক্রেতা শুধু প্রতারিতই হচ্ছেন না, হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্যও। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। দেশে খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রতিষ্ঠান তিনটির জনবলস্বল্পতা, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইনের দুর্বলতা এবং অভিযান পরিচালনার সময় আইনশৃঙ্খলা ও ম্যাজিস্ট্রেটস্বল্পতার কারণে তাদের পরিচালিত অভিযানে ভোক্তারা তেমন সুফল পাচ্ছেন না। ভোক্তাদের ভাষ্যমতে, এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অপরাধীদের শাস্তি আরও বাড়াতে হবে।

দেশে উৎপাদিত পণ্যের মান প্রণয়ন, প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রী উৎপাদন ও গুণগত মান পরীক্ষা বা বিশ্লেষণ করে মানের নিশ্চয়তা প্রদান বিএসটিআইর কাজ। এ কাজে আরও তদারকি করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও ঢাকা সিটি করপোরেশন। তবে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সূত্রে জানা যায়, বিএসটিআই মাত্র ১৫৫টি পণ্য বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা করছে। বাকি পণ্যগুলো বাধ্যতামূলক না হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা এগুলোতে ভেজাল মেশাচ্ছেন। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণে ১০ জন স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের পদ আছে, কিন্তু বর্তমানে ২টি পদ খালি। এ ছাড়া নমুনা সংগ্রহকারীরাও নিয়মিত নন। সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সংখ্যাও অপর্যাপ্ত। দক্ষিণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য আছেন মাত্র তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট। আর অভিযান পরিচালনার সময় প্রায়ই পুলিশের সংকট দেখা দেয়। এত বড় শহরে এত কমসংখ্যক জনবল দিয়ে অভিযান পরিচালনা সত্যিই দুরূহ  কাজ। ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আমাদের আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি খুব একটা হয় না। এ ছাড়া পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতার অভাব আছে। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর আছে। তবে সেফ ফুড অথরিটি কার্যকর হতে সময় লাগবে। হলে বর্তমান সমস্যা অনেকটা কমে আসবে। সরকারকে দেশের পণ্যগুলোর মান নিয়ন্ত্রণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাঠামো গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়া ডিসি ও পুলিশদেরও পণ্যে ভেজাল রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি একই সঙ্গে পণ্যে ভেজালকারীদের দ্রুত শাস্তি প্রদান ও জরিমানা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন। বিএসটিআইর যে ১৫৫টি পণ্যের মান পরীক্ষা করা হয় তার মধ্যে খাদ্য ও কৃষিজাত ও রাসায়নিক পণ্য যেমন- দুগ্ধজাত, শিশুখাদ্য, মসলাজাতীয় খাবার, জুস, তেল, সাবানসহ বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী রয়েছে। এগুলোতেই সবচেয়ে বেশি নকল ও ভেজাল তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে গুঁড়া দুধ, নুডলস, সস, তেল, টুথপেস্ট ইত্যাদিরও নকল তৈরি হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন সুপার শপেও বিএসটিআইর সিল ছাড়া বিভিন্ন প্রসাধনী ও খাবার বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছ। এ ছাড়া পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সঠিকভাবে নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না। এ কারণে মানহীন বিভিন্ন পণ্য দেশে আসছে। বিএসটিআই সূত্রে জানা যায়, বিদেশ থেকে মানহীন চকোলেট, ক্যান্ডি এনার্জি ড্রিংক, বডি লোশন, শেভিং ক্রিম ইত্যাদি দেশের বাজারে ঢুকে পড়ছে। আমদানিনীতি আদেশ ২০১২-১৫ অনুযায়ী আমদানিকৃত ৪৩টি পণ্যের ক্ষেত্রে বিএসটিআই থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার পর পণ্য খালাসের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু তালিকাবহির্ভূত অসংখ্য পণ্য দেশে আসছে। দেশে বর্তমানে পণ্যের ক্যাটাগরি রয়েছে ৪ হাজারের ওপর। কিন্তু বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ বাধ্যতামূলকভাবে মাত্র ১৫৫টি পণ্যের মান তদারকি করছে। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরাও বাজারে মানহীন পণ্য বিক্রি করছেন। বিএসটিআইর মহাপরিচালক ইকরামুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা ১৫৫টি পণ্যের মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছি। তবে এ কথা ঠিক, কিছু কিছু পণ্যে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। মানহীন পণ্য নিয়ন্ত্রণে আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। সিটি করপোরেশন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কর্তৃপক্ষও অভিযান চালাচ্ছে। ফলে আমরা একই সময়ে একই শহরে সব সময় যে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সহযোগিতা পাব, এমন নয়। আর জনবল সমস্যা সব জায়গাতেই আছে। পণ্যের মান পরীক্ষার জন্য মাঠ পর্যায়ের স্যানিটারি পরিদর্শকরা ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করেন। এসব নমুনা জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধীন পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিতে পাঠান। সরকারি এ প্রতিষ্ঠান ৪৩টি খাদ্যপণ্যের মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ২ হাজার ১৪৭টি নমুনাতেই মাত্রাতিরিক্ত ও ভয়াবহ ভেজাল পাওয়া যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা লাভের আশায় সঠিক ও বিশুদ্ধ খাদ্য উপাদানের পরিবর্তে শিশুখাদ্যে ব্যবহার করছেন বিষাক্ত কেমিক্যাল ও পচা ফলমূল। নিষিদ্ধ মোম, নিম্নমানের রং, ট্যালকম পাউডার ও ঘনচিনির মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে একলেয়ারসহ বিভিন্ন কোম্পানির নকল ও ভেজাল চকোলেট। আর দেশে চাহিদা থাকায় বিপুল পরিমাণ ভেজাল গুঁড়া দুধ তৈরি হচ্ছে। শিশুদের জুসে যে নির্দিষ্ট কয়েকটি ফলের ফ্লেভার থাকার কথা তা আসলে দেওয়া হচ্ছে না। বরং এতে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ও কৃত্রিম রং। বিভিন্ন কোম্পানির লবণ মালিকরা লবণে আয়োডিন না দিয়েই ক্রেতার কাছে তা আয়োডিনযুক্ত লবণ বলে বিক্রি করছেন। এ ছাড়া রাজধানীর শপিং মল ও দোকানগুলোয় দেদার বিক্রি হচ্ছে নকল প্রসাধনী। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্যানটিন প্রোভি, থাইল্যান্ডের হেড অ্যান্ড শোল্ডার, ভারতের গার্নিয়ার শ্যাম্পুসহ নামিদামি কোম্পানির পণ্য। ক্যাবের তথ্যমতে, বাজারের ৪৫ ভাগ প্রসাধনী পণ্যের বিএসটিআইর সনদ নেই, আর ৭৫ ভাগের উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বি. জে. মাহাবুবুর রহমান বলেন, নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ কার্যকর হতে কিছু সমস্যা ছিল। আমরা শিগগিরই বাজার থেকে পণ্যের নমুনা সংগ্রহ শুরু করছি। তবে আগের থেকে খাদ্যে ফরমালিনের ব্যবহার কমেছে। আমরা এখনো শতকরা ৩০ ভাগ খাবারে ভেজাল পাচ্ছি। এ জন্য অপরাধীদের আরও কঠিনভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর