মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

সংকটে ৫৫০ বছরের সুরা মসজিদ

রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর

সংকটে ৫৫০ বছরের সুরা মসজিদ

৫৫০ বছর আগে নির্মিত দিনাজপুরের টেরাকোটা অলঙ্করণ ও পোড়ামাটির চিত্রফলকের সুরা মসজিদ এখন অস্তিত্ব সংকটে। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ এ মসজিদটি এখনো মানুষের কাছে আকর্ষণীয়। প্রতিদিনই মসজিদটি দেখতে ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ। এ  মসজিদ ঘিরে রয়েছে নানা কল্পকথা। মসজিদের অবকাঠামোগত অনেক কিছুই বিলীনের পথে। ঘোড়াঘাট-হিলি রাস্তার পাশে দিনাজপুরের প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম এ সুরা মসজিদ। আবার কেউ কেউ বলেন সুজা মসজিদ।

মসজিদটি জনহীন এক জনপদের নীরব সাক্ষী। এর নাম নিয়ে আছে নানা কথা। কেউ বলেন সৌর মসজিদ, কেউ সুরা মসজিদ, আবার কেউ বলেন শাহ সুজা মসজিদ। সুর শব্দের অর্থ অপদেবতা বা জিন। স্থানীয়রা জানান, তৎকালীন সময়ে এক রাতের মধ্যে জিনেরা এটি নির্মাণ করে দেয়, তাই এর নাম সুরা মসজিদ হয়েছে। সৌর শব্দের অর্থ আসমানি বা গায়েবি। জনশ্রুতি রয়েছে গায়েবিভাবেই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। আবার অনেকের মতে, মোগল আমলে বাংলার নবাব সুজা এটি নির্মাণ করে  দেন বলে এর নাম শাহ সুজা মসজিদ হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, শাহ সুজা ক্ষমতা গ্রহণের অনেক আগে এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। মসজিদের নামকরণ ও নির্মাণসংক্রান্ত বিষয়ে উপরে উলি­খিত কোনো তথ্য সঠিক বলে মেনে  নেওয়া যায় না। কারণ যে ক্ষেত্রে মসজিদের শিলালিপি বা প্রমাণ পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রে নির্মাণশৈলী বা স্থাপত্য কাঠামো নির্মাণকাল নির্ধারণে একটি অনুষঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। এ ক্ষেত্রে মসজিদের শিলালিপি নেই। তাই গঠনশৈলীর ওপর ভিত্তি করেই সম্ভাব্য নির্মাণকাল বের করা যায়। এ মসজিদে কোনো শিলালিপি বা সময় নির্ধারণে অন্য কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়নি। তবে গঠন কৌশল দেখে ধারণা করা হয়, এটা হোসেন শাহের আমলের। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক দানী এটিকে গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ-এর আমলে নির্মিত বলে অনুমান করেন। এই মসজিদটি সুলতানি আমলে (১৪৯৩-১৫১৮) খ্রিস্টাব্দে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। মুসলিম আমলে গৌড় থেকে ঘোড়াঘাট যাওয়ার পথ ছিল একই। এ সময় মুসলমানদের নামাজ পড়ার সুবিধার জন্য খুব সম্ভব এখানে এই মসজিদ তৈরি হয়েছিল। ঘোড়াঘাটে মুসলিম আমলের পাকা ঘাটওয়ালা বিশাল দিঘির পাশেই এই সুরম্য মসজিদ। বারান্দাসহ পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এই মসজিদের মাপ প্রায় ৪২ূ২৬ ফুট। বারান্দার বাইরের মাপ প্রায় ১৪ূ২৬ ফুট। বারান্দার ভিতরের মাপ প্রায় ১৬ূ৮ ফুট। চার ফুট উঁচু মজবুত প্লাটফর্মের ওপর মসজিদের কাঠামো গড়ে উঠেছে। প্রধান কক্ষের সঙ্গে যুক্ত আছে ৬ ফুট প্রশস্ত রাস্তা। বারান্দার পরেই মসজিদের প্রধান কামরা এবং সেই কামরার ভিতরের আয়তন প্রায় ১৬ূ১৬ ফুট। পূর্ব-পশ্চিম ও মাঝের দেয়াল প্রায় ৮ ফুট করে পুরু। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে ৩টি করে দরজা। মাঝের দরজা দুটি পাশের দরজাগুলোর চেয়ে আকারে বড়। বারান্দাসহ উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে দরজা। ভিতরে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে ৩টি মিহরাব। মাঝের মিহরাবটি আকারে বড়। মসজিদের ৪টি মিনার বা স্তম্ভ ছিল। এগুলো পাথরের তৈরি এবং পাথর কেটে মাপ মতো এগুলো তৈরি করা হয়েছিল। মিনারগুলো দেয়ালের ইটের সঙ্গে শক্তভাবে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল বলে মিনারগুলো ছাদের কিছু উপরে উঠেছিল। এখন ছাদ পর্যন্তই রয়েছে। মসজিদের কার্নিশগুলো বাঁকানো। প্রধান কামরার প্রত্যেক কোণে এবং প্রত্যেক দেয়ালের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে ভিতরে ইটের দেয়ালের বাইরের দিকে পাথরের মোটা গাঁথুনি রয়েছে এবং সেগুলো ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। প্রত্যেক দরজার চৌকাঠও পাথরের তৈরি। প্রধান কামরার উপরে রয়েছে একটি মাত্র গম্বুজ। এটি চার পাশের দেয়ালের উপরে তৈরি এবং বেশ উঁচু। গম্বুজটি দেখতে বেশ মনোরম। বারান্দার উপরে রয়েছে তিনটি ছোট গম্বুজ। মসজিদের বাইরে কোনো প্লাস্টার নেই। পরিবর্তে অতি সুন্দর পোড়ামাটির চিত্রফলকের কাজ ছিল। নানা রকম লতাপাতা, ফুল, ঝুলন্ত শিকল ইত্যাদির কাজ অতি উন্নতমানের ছিল। মসজিদের ভিতরে মিহরাবগুলোও একই ধরনের পোড়ামাটির চিত্রফলকের। মসজিদের বাইরের দিকে দেয়ালের গায়ে ছোট ছোট খোপকাটা  টেরাকোটা অলঙ্করণ ইমারতের বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। লতা জাতীয় অভিনব নকশায় বাইরের দেয়াল সুসজ্জিত যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখন এসব কাজের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। ঘোড়াঘাটের সুরা মসজিদের মোতওয়ালি­ সেকেন্দার আলী জানান, প্রাচীন এ সুরা মসজিদ দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন আসে। এ মসজিদে এখনো নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদটিকে সংস্কার এবং এর নির্মাণশৈলী পুনর্নির্মাণ করা হলে ব্যাপকহারে দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর