বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চিকিৎসার নামে শুধুই অবহেলা পটুয়াখালী হাসপাতালে

সঞ্জয় কুমার দাস, পটুয়াখালী

চিকিৎসার নামে শুধুই অবহেলা পটুয়াখালী হাসপাতালে

পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তারসহ জনবল সংকটের কথা প্রচার করে চিকিৎসাসেবার নামে চলছে নানান ফাঁকিবাজি। ফলে রোগীদের নামকাওয়াস্তে চিকিৎসাসেবাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। বহির্বিভাগে প্রতিদিন সহসাধিক রোগী সেবা নিতে এলেও যেনতেন সেবা নিয়েই তাদের ফেরত যেতে হচ্ছে। এই সঙ্গে হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অসাধু চক্র স্বার্থ হাসিলের নানা কারবার করে যাচ্ছে।

এ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া গেছে বিস্তর অভিযোগ। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পরীক্ষাগারে লোকবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকলেও কমিশন পাওয়ার জন্য কৌশলে রোগীদের বাইরে পাঠানো হয়। প্রতিদিন সকালে ওয়ার্ড পরিদর্শনে যাওয়ার কথা থাকলেও খোদ তত্ত্বাবধায়ক নিজেই ওয়ার্ডে যান কালেভদ্রে। ডাক্তারদের নিজস্ব চেম্বার এবং বেশির ভাগ চিকিৎসক ক্লিনিক ব্যবসায় জড়িত থাকায় তারা হাসপাতালে তেমন একটা সময় দেন না। রোগীরা এ জন্য হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হয়ে চলেছেন। হাসপাতাল সূত্রে প্রকাশ, পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট নিরসনে কর্তৃপক্ষ বার বার উদ্যোগ নিলেও পূর্ণতা পায়নি এখনো। হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীতের পর নতুন জনবল কাঠামো অনুযায়ী তত্ত¡াবধায়কসহ ৫৮ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ২০ জন। সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার‌্যালয় থেকে ১০ চিকিৎসক প্রেষণে রয়েছেন জেনারেল হাসপাতালে। সিনিয়র কনসালট্যান্টের ১০টি পদ থাকলেও শুধু গাইনি, অ্যানেসথেসিয়া, মেডিসিন, চক্ষু, চর্ম ও যৌন ছাড়াও অন্য চারটি পদ রয়েছে শূন্য। এগুলো হচ্ছে সার্জারি, শিশু, ইএনটি, আই, কার্ডিওলোজি, অর্থোপেডিক। জুনিয়ার কনসালট্যান্টের ১১ পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ছয়জন। শূন্যপদগুলো হচ্ছে চক্ষু, কার্ডিওলজি, রেডিওলজি, প্যাথলজি, শিশু ও সার্জারি। আবাসিক ফিজিশিয়ান, আবাসিক সার্জন পদ দুটিও রয়েছে শূন্য। ডেন্টাল সার্জন, প্যাথলজিস্ট কর্মরত থাকলেও অ্যানেসথেসিস্ট তিনটিসহ রেডিওলজিস্ট এ চারটি পদ শূন্য রয়েছে। মেডিকেল অফিসারের ১০টি পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র তিনজন। সহকারী রেজিস্ট্রারের ১১ পদে কর্মরত আছেন মাত্র একজন। জরুরি বিভাগে মেডিকেল অফিসারের চারটিসহ আয়ুর্বেদিক মেডিকেল অফিসার পদ শূন্য রয়েছে। নার্স বিভাগের সুপারভাইজার সিনিয়র স্টাফ নার্স দীপালি পাল জানান, ৮৪ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের স্থলে দায়িত্ব পালন করছেন ৭৬ জন। সহকারী নার্স আছেন চারজন, এলএনএসসহ মোট নার্স রয়েছেন ৯২ জন।

অভিযোগ অনুযায়ী, এসব শূন্যতা এবং সংকটের বিষয় তুলে ধরে স্বার্থান্বেষী মহল নানা বাণিজ্য করে চলেছে। রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, স্বার্থবাজদের কারণে দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন এবং কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা ঠিক সময়ে এসে ডাক্তার পান না। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সরকারি ওষুধ দেওয়া হয় না। আন্তবিভাগে ভর্তি হওয়া রোগীদেরও তেমন কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। এমনকি গজ, লিকোপ্লাস্ট, ডিসপোজাবল সিরিঞ্জ, তুলাসহ বিভিন্ন জিনিস রোগীদের বাইরে থেকে কিনে এনে দিতে হয়। সরকার থেকে এগুলো বরাদ্দ থাকলেও রোগীদের জন্য এগুলো ব্যবহার না করে বাইরে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তালিকা অনুযায়ী রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী জনপ্রতি রোগীর পাউরুটি, দুধ, চিনি, দেশি মোরগ-মুরগি, খাসির মাংস ও সবজি বরাদ্দ থাকলেও এগুলো রোগীদের দেওয়া হয় নামকাওয়াস্তে। যেটুকু দেওয়া হয় তা-ও মুখে তোলা যায় না অখাদ্য হওয়ার কারণে। এ অবস্থায় রোগীরা বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে খাবার কিনে খান। চরাঞ্চল থেকে সেবা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জেলা শহরের চিকিৎসা নিতে এসে তাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর সাধারণ রোগীদেরও অনেক ক্ষেত্রেই রেফার করা হয় বরিশাল ও ঢাকায়। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, বিভিন্ন অপারেশনসহ মুমূর্ষু রোগীর সেবা এখানে হয় না বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা নানান অজুহাত দেখিয়ে রেফার করেন বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল অথবা ঢাকার কোনো হাসপাতালে। কোনো কোনো চিকিৎসক আবার শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে ভালো চিকিৎসা পাওয়ার লোভ দেখিয়ে সেখানে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। সরেজমিনে দেখা যায়, জরুরি বিভাগে ডাক্তার প্রায় ক্ষেত্রেই থাকেন না। হঠাৎ থাকলেও তারা শুধু ব্যবস্থাপত্র দিয়েই কাজ শেষ করেন। তাদের জায়গায় রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন ব্রাদাররা। জানা গেছে, চেম্বার আর ক্লিনিক ব্যবসার কারণে চিকিৎসকরা ওয়ার্ডে আসেন না। দেখা যায়, হাসপাতালে সবচেয়ে দুর্বিষহ অবস্থা পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থায়। হাসপাতালের সামনে বিশেষ করে শিশু ওয়ার্ডের চারপাশে ময়লা-আবর্জনার স্ত‚প থাকায় দুর্গন্ধে চলাফেলা দুষ্কর। এর মধ্যেই মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ড, পেইন বেড ওয়ার্ড, মহিলা ও শিশু ওয়ার্ডের বেশির ভাগ টয়লেটই ব্যবহার অনুপযোগী। পানি সরবরাহব্যবস্থা যেনতেন। ময়লা-আবর্জনায় এবং দুর্গন্ধে টয়লেটে গিয়ে অনেক রোগী আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

অভিযোগে জানা গেছে, হাসপাতাল ঘিরে টেন্ডার ও মেডিকেল সার্টিফিকেট বাণিজ্যের জন্য গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। একটি সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে ৫০ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জেনারেটর বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা এখনো বাক্সবন্দী পড়ে আছে। দুই ফেসে বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা চালুর জন্য গণপূর্ত টেন্ডার সম্পন্ন করলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এখনো সংযোগ দেওয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন বার বার। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের হিসাবরক্ষক নিজেই হাসপাতালের টেন্ডার সিন্ডিকেটের হোতা। কয়েকজন কর্মচারী তার সহযোগিতায় রয়েছেন। খাবার সরবরাহসহ হাসপাতালের যে কোনো টেন্ডারের ভাগ-বাটোয়ারা হয় তারই নেতৃত্বে। এমনকি সরকারি ওষুধ বাইরে বিক্রি করারও অভিযোগ রয়েছে এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, অফিসের হিসাব সহকারী হাসপাতাল সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য। মামলা-মোকদ্দমাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহƒত ছাড় পাওয়া রোগীর মেডিকেল সার্টিফিকেট বাণিজ্য করেন তিনি। রোগীর ধরন ও প্রকারভেদে সার্টিফিকেট দিয়ে তিনি হাতিয়ে নেন ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। এসব ব্যাপারে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ফারুক খান বলেন, ‘আমি দুই মাস আগে যোগদান করেছি। নতুন এসেছি তাই অনেক কিছুই জানা নেই। তবে সবকিছু বলতে পারবেন তত্ত্বাবধায়ক।’ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মিটিং ও অফিসের কাজ করতে হয় তাই প্রতিদিন সকালে ওয়ার্ডে যাওয়া সম্ভব হয় না। আমার সহকারী পরিচালক (এডি) প্রায়ই ওয়ার্ডগুলো সকালে পরিদর্শন করেন। বর্তমানে চিকিৎসকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকট রয়েছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়ে জানিয়ে জরুরি ভিত্তিতে শূন্যপদে চিকিৎসক নিয়োগের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। খাবার বিতরণে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। কারণ মাঝেমধ্যে আমি নিজেই পরিদর্শন করি। অনিয়ম ও দুর্নীতি আর সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগ পেলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।’ জেলা সিভিল সার্জন ডা. এ এম মজিবুল হক বলেন, ‘আড়াই শ’ শয্যা হাসপাতালের ব্যাপারে আমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই। ওখানে সুপার রয়েছেন তিনি বলতে পারবেন সবকিছু।’ সদর থেকে ১০ জন ডাক্তার হাসপাতালে প্রেষণে দিয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এটি করা হয়েছে।’ ইউনিয়নের স্বাস্থ্যসেবা কীভাবে চলছেÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডাক্তার না থাকায় ইউনিয়নের সেবা চলে না।’

সর্বশেষ খবর