দেড় যুগ ধরে ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে চলছে ১০০ শয্যার ভোলা সদর হাসপাতাল। তাও চলছে কাগজে-কলমে। বাস্তবে ২০ শয্যার জনবলও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে চিকিৎসা, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় কোনো সেবাই পাচ্ছে না রোগীরা।
রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় বাইরে থেকে ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হচ্ছে। ওষুধ, অক্সিজেনের অভাবেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ১৬ নভেম্বর রোগীর এক স্বজন রোজিনা আক্তার জানান, ভেলুমিয়া থেকে দুদিন আগে দুর্ঘটনায় আহত রোগী নিয়ে তিনি এসেছেন। কিন্তু দুই দিনেও চিকিৎসকের দেখা পাননি। ধনিয়া এলাকার রোগীর স্বজন জয়নব বিবি বলেন, ‘৫ দিনে ডাক্তারের দেখা পেয়েছি মাত্র ৩ বার। তাও দ্রুত এসেই চলে গেছেন।’ গাইনি ওয়ার্ডের রোগী সুমা আক্তার বলেন, ‘চিকিৎসক ও নার্স সংকট থাকায় আমরা হাসপাতালে এসেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছি না।’ ভেদুরিয়া এলাকার এক রোগীর স্বজন জামাল হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাইরে থেকে ৩ হাজার টাকার টেস্ট করিয়েছি। আমরা গরিব রোগী, খুব বিপদের মধ্যে রয়েছি।’ শান্তিরহাট থেকে আসা মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডের রোগীর স্বজন জান্নাত বলেন, ‘৩ দিন ধরে রোগী নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। ডাক্তারের দেখা পেয়েছি মাত্র একবার। হাসপাতাল থেকে সামান্য কিছু ওষুধ দিলেও অধিকাংশ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।’ দৌলতখান উপজেলার মিয়ারহাট থেকে আসা গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগী সুমা বেগম বলেন, ‘পেটব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু ৩ দিনেও রোগ নির্ণয় হয়নি। ঠিকমতো ডাক্তারই পাওয়া যাচ্ছে না।’ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালে বিরাজ করছে দুর্গন্ধময় পরিবেশ। রোগীর সঙ্গে স্বজনরাও এ কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। টিউবওয়েল নষ্ট থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে খাবার পানি আনতে হয়। হাসপাতাল থেকে দু-একটি ওষুধ দেওয়া হলেও অধিকাংশ ওষুধ বাইরে থেকেই কিনতে হয়। অভিযোগে জানা গেছে, হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাম, রক্ত ও এক্স-রে মেশিন থাকলেও ইজিজি মেশিন বিকল হয়ে আছে। সবরকম পরীক্ষা হয় না হাসপাতালে। রোগীদের যেতে হয় স্থানীয় ক্লিনিকগুলোতে। জেলার ১৮ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবার জন্য একমাত্র ভরসা ভোলা সদর হাসপাতালে শয্যার অভাবে নারী ও পুরুষ মেডিসিন, সার্জারি, অর্থপেডিকস, গাইনি, ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে প্রায়ই রোগীদের মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হয়। এক বছরের অধিক সময় এনেসথেসিয়া চিকিৎসক না থাকায় বন্ধ রয়েছে সব ধরনের অপারেশন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভোলা সদর হাসপাতাল। এরপর ১৯৯৮ সালে ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও জনবল কাঠামো বাড়ানো হয়নি। সিভিল সার্জন কার্যালয় জানায়, ২২টি চিকিৎসকের পদের মধ্যে ১৭টি এবং নার্সের ৫২টি পদের মধ্যে ৩৬ পদ শূন্য রয়েছে। হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ আরএমও পদটিও শূন্য। শূন্যপদগুলোর মধ্যে রয়েছে ১২টি মেডিকেল অফিসারের মধ্যে ১১টি এবং ১০টি কলসালটেন্টের মধ্যে ৬টি পদ। অন্যদিকে ৩৬টি সিনিয়র স্টাফ নার্সের মধ্যে ২৯টি, ১১টি স্টাফ নার্সের মধ্যে ৫টি এবং ৫টি জুনিয়র নার্সের মধ্যে একটি শূন্য রয়েছে। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা, অন্যদিকে হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রমও ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সামি আহমেদ বলেন, ছোট ছোট কাটাছেঁড়া ও ভাঙার চিকিৎসা হলেও বড় ধরনের অপারেশন বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে সিজারিয়ান অপারেশনও। এতে রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ইকবাল আহমেদ জানান, ডাক্তার সংকট তীব্র। একজনের পক্ষে এত রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। দিনের বেলা কমপক্ষে ৬ জন চিকিৎসক থাকা জরুরি। কিন্তু সে তুলনায় চিকিৎসক নেই। ভোলার সিভিল সার্জন ডা. ফরিদ আহমেদ বলেন, ডাক্তার সংকট থাকায় চিকিৎসা সেবা কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। তবুও চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। চিকিৎসক ও নার্সের পদায়ন চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। সেখান থেকে শিগগিরই চিকিৎসক দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে।