শিরোনাম
রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ঘনিয়ে আসছে বিচ্ছেদ

জয়নাল পরিবারের সবাই কাঁদছেন ডুকরে ডুকরে

ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা সদরে অবস্থিত বিলুপ্ত দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীনের (৪৫) পরিবারে এখন বিচ্ছেদের সুর। ভারতে যাওয়ার দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই পরিবারে বাড়ছে কান্নার রোল। এতদিন চাপাকান্না থাকলেও এখন তা হাহাকারে পরিণত হয়েছে। বিচ্ছেদের বেদনায় সবাই কাঁদছেন ডুকরে ডুকরে।

জয়নাল তার পরিবারের বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও চার সন্তানকে ছেড়ে (বাংলাদেশে রেখে) একাই ভারতে যাচ্ছেন। ২৪ নভেম্বর দাসিয়ারছড়া থেকে ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী ৩০ পরিবারের ১৫০ জনের সঙ্গে জয়নাল ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বাগভাণ্ডার-সাহেবগঞ্জ (ভারতের) সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাবেন। যৌথ গণনায় জয়নালের পরিবারের সবাই বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার অপশন দিলেও জয়নাল একাই ভারতে যাওয়ার অপশন দেন। পরিবারের সবার ধারণা ছিল, কিছু দিন গেলে স্ত্রী, সন্তান, মা এবং ভিটার টানে জয়নাল তার মত পরিবর্তন করবেন। কিন্তু পরিবারসহ পাড়া-প্রতিবেশীর অনুরোধ, মা ও সন্তানের প্রতি ভালোবাসা তার মনে সামান্য করুণার উদ্রেক করেনি। বরং তার মতামতের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় পরিবারের সবাইকে পথে বসাতে বাস্তুভিটার শেষ আশ্রয়টুকুও বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন জয়নাল। দাসিয়ারছড়ার বোর্ডেরহাট এলাকার চেয়ারম্যানটারীতে জয়নালের বাড়ি। জয়নালের উপার্জনে চলা পরিবারটির কী হবে, এ নিয়ে চিন্তিত প্রতিবেশীরাও। সরেজমিন গতকাল দুপুরে জয়নালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির দক্ষিণের ঘরের দরজায় মাথায় হাত দিয়ে মা জামেলা বেওয়া (৬৭) কাঁদছেন। পাশে বসে বিষণ্ন মনে মাথা নিচু করে আছেন স্ত্রী আকলিমা বেগম (৪০)। এ সময় গঙ্গারহাট মোহাম্মদ আলী উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ইয়াছমিন ও ছোট মেয়ে ছিট চন্দ্রখানা ব্র্যাক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী জেনিফা আক্তার (৯) বাড়িতে ফেরে। জয়নালের কথা জানতে চাওয়ায় ভয়ে ও শঙ্কায় সবাই চুপ হয়ে হয়ে যান। এক পর্যায়ে মা জামেলা কাঁদতে শুরু করলে একে একে সবাই ডুকরে কাঁদা শুরু করেন। তাদের কান্নার শব্দে প্রতিবেশীরা এসে জড়ো হন। ভিড় বাড়তে থাকে। প্রতিবেশীরা সবাইকে সান্ত্বনা দেন। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাতেই কান্না থামে না। একসময় জামেলা বেওয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘মোর একেটা (একটি) ব্যাটা, উইয়াক (ওকে) ভারত যাবার দিব্যার (দিব) নং (না)। মোর বুকের ধন। উয়ায় গেইলে (গেলে) মুই কাক (কাকে) নিয়া বাঁচিম বাহে। জীবনটা এটি (এখানে) শ্যাষ করলং। অ্যালা (এখন) হামরা (আমরা) ক্যা (কেন) ভারত যামো (যাব)। অ্যাটে হামরা বেটির (মেয়ের) বিয়া দিছি, সাগাই সোদর (আত্মীয়স্বজন) সবায় কাচোত (কাছে)। ওমাক (জয়নালকে) বাংলাদেশত থাকার ব্যবস্থা করি দেও (দেন)।’ এটা জয়নালের স্ত্রী আকলিমা বেগমেরও আর্জি। ছোট মেয়ে জেনিফা বলে, ‘সবার বাবা থাকবে। আমার বাবা থাকবে না। থেকেও নেই। কষ্টে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্কুলে সবার বাবা যাবে আমার বাবা যাবে না। ভাবতে খুব খারাপ লাগে।’ ‘বাবাকে এখানে থাকতে বলছি, কিন্তু থাকবেন না’ বলে কেঁদে ফেলে ইয়াছমিনও। প্রতিবেশী আতাউর রহমান বলেন, ‘আমরা পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভারতে যাচ্ছি। কিন্তু জয়নাল তার মা, স্ত্রী ও সন্তান ফেলে যাচ্ছে। এটা অমানবিক। তাকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু বোঝার চেষ্টা করছে না। পরে কষ্ট পাবে।’ জয়নালের চাচা আবেদ আলী (৭০) বলেন, ‘ভাইসতাক (ভাতিজা) বুজাবার (বোঝাতে) পাইরলং (পারলাম) না বাহে। উয়ার পরিবার দুই দ্যাশত (দেশে) ভাগ হয়া (হচ্ছে) যাবার নাইগছে, হামারও কষ্ট হবার নাইগছে।’ চাচি সুফিয়া বেগম ও খোতেজা বেগম বলেন, ‘কদ্দিন একসাথে থাকলং। মা ও বউ-ছোয়াক থুইয়া জয়নালই বা থাকবে ক্যামন করি।’ এদিকে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ১৩ শতক ভিটেমাটির মধ্যে ছিটমহলের প্রাক-জরিপে নিজ নামে পাওয়া ৯ শতক জমি বিক্রি করতে তোড়জোড় শুরু করেছেন জয়নাল। তিনি বলেন, ‘আমি ভারতের ছিটের নাগরিক। সুযোগ পেয়েছি ভারত যাব। কোটি টাকা দিলেও আমি বাংলাদেশে থাকব না।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ দেশে থাকলে কোনো উন্নতি হবে না। ভারতে গেলে কাজ মিলবে।’ জমি বিক্রি করলে স্ত্রী-সন্তানরা থাকবে কোথায়- জানতে চাওয়ায় তার সাফ জবাব, ‘আমার কিছু করার নেই। তাদের বলেছি আমার সঙ্গে যেতে। তারা যাবে না। যেখানে ইচ্ছা সেখানে থাকবে।’ প্রসঙ্গত, আজ দাসিয়ারছড়া থেকে ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী ১০ পরিবারের ৪৮, মঙ্গলবার ৩০ পরিবারের ১৩৮ এবং বৃহস্পতিবার ২৭ পরিবারের ৯৫ জন ভারতে যাবেন।

সর্বশেষ খবর