রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ফাঁসির খবর

সারা জীবন এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী

জিন্নাতুন নূর

সারা জীবন এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম

‘মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ছিল আমিসহ সব শহীদ পরিবারের সদস্যদের সারা জীবনের আকাক্সক্ষা। আমরা সারা জীবন এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে এ দুজনই ছিল সবচেয়ে বেশি ঘৃণ্য ও দুর্ধর্ষ। এতদিন আমরা শুধু অপেক্ষা করেছি, কবে তারা ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে।’ বুদ্ধিজীবী ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

এই শহীদজায়া বলেন, ‘আমরা এতদিন ধরে এ দিনটি দেখব বলে সমস্ত আগ্রহ নিয়ে বসে ছিলাম। এদের হাতেই মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের আত্মীয়-পরিজনসহ ভাই-বোনেরা মারা গিয়েছেন। এরা ’৭১-এ নির্মম অত্যাচার করে মানুষকে হত্যা করেছিল। নির্মমতার সে কী পৈশাচিক রূপ- চোখ তুলে, হৃৎপিণ্ড খুবলে নিয়ে মানুষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তারা হত্যা করেছিল। সেই নির্মম হত্যার দুঃসহ স্মৃতি আমাকে প্রতি মুহূর্তেই কষ্ট দেয়। প্রতি মুহূর্তে চোখের জল পড়ে। আজ তাদের শাস্তি হচ্ছে, আমরা যা চেয়েছিলাম তা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। আমরা এ দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম, এ অপেক্ষা দীর্ঘ ৪৩ বছরের। এতদিন মনের ভিতরটায় দুঃখের যে ভারী পাথর জমে ছিল তা যেন গলে যাচ্ছে। এখন শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে এবং আমাদের মনেও এক শ’ ভাগ শান্তি আসবে।’

দেশের এ দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সম্পর্কে বলতে গিয়ে শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘সে সময় মুজাহিদ ইসলামী ছাত্র সংঘ করত। সেখান থেকে সে আলবদর বাহিনীতে যোগ দিল। আলবদর বাহিনীর সদস্য হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করল। আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে মুজাহিদের প্রত্যক্ষ মদদে বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে মিরপুর শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যে অত্যাচার চালানো হয় তা মুজাহিদই করিয়েছে। আমার স্বামীর রক্তাক্ত লাশ আমি দেখেছি, তারা কীভাবে তাকে হত্যা করেছে। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ। কী নৃশংসভাবে তারা তাকে হত্যা করেছে। এই লোক আমার স্বামীসহ অন্যদের হত্যা করেছে। আলতাফ মাহমুদ, বদি, রুমি এদেরও মুজাহিদ মেরেছে। এটা যে কত বড় কষ্টের- বলে প্রকাশ করা যাবে না। আরও দুঃখ আমরা পেয়েছিলাম যখন এদের পুনর্বাসিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। এরপর ২০০২ থেকে নিজামী, মুজাহিদরা ক্ষমতায় বসল। এদের গাড়িতে দেশের পতাকা উড়ল। এরা মন্ত্রী হলো। আমাদের দেখতে হয়েছে যে এই খুনিরা মন্ত্রী হয়ে তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে। এগুলো দেখে আমরা ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। এ ছাড়া মুজাহিদ অনেক ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। সে বলেছে বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। তার কোনো অপরাধ নেই, তারা কিছু করেনি। এমনকি রায় হওয়ার পরেও সে তার ছেলেকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে যে, তার কোনো দোষ নেই, সে নির্দোষ। তাকে যে বিচার করা হয়েছে তা অন্যায় বিচার। কত বড় ধৃষ্টতা তার!’

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সম্পর্কে এই শহীদজায়া বলেন, ‘সাকা চৌধুরী তার এলাকা রাউজানে ওই সময় যেসব হিন্দু মেয়ে ছিল তাদের ধর্ষণ করা, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াসহ অসংখ্য লোককে সে হত্যা করে। সে নিজে অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। পাকিস্তানিদের নিয়ে গিয়ে সে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তার বাড়িতে বহু মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে সে হত্যা করেছে। এমনকি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বন্দী হওয়ার পর বিচারকাজ চলাকালে কোর্টে উপস্থিত হয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। প্রসিকিউটরদের বাজে কথা বলেছে।’

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘আমি শেষে এতটুকুই বলতে চাই যে, এ দুজন যুদ্ধাপরাধীর অপরাধের সীমা নেই। আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ।’

সর্বশেষ খবর